بِسۡمِ اللّٰہِ الرَّحۡمٰنِ الرَّحِیۡمِِ
১ সেপ্টেম্বর, ২০২৩
জার্মানি জলসা ২০২৩: শতবর্ষ উদযাপনের সেরা উপায়
স্টুটগার্ট, জার্মানি
  • সারমর্ম
    এই জুমু’আর খুতবার সারাংশটিতে কোনো প্রকার ত্রুটি-বিচ্যুতি থাকলে তার দায়ভার আহ্‌মদীয়া বাংলা টীম গ্রহণ করছে।

    নিখিলবিশ্ব আহমদীয়া মুসলিম জামাতের বর্তমান ইমাম ও আমীরুল মু’মিনীন হযরত মির্যা মসরূর আহমদ খলীফাতুল মসীহ্ আল্ খামেস (আই.) গত ১লা সেপ্টেম্বর, ২০২৩ তারিখে স্টুটগার্টের জলসা গাহে “জার্মানি জলসা ২০২৩: শতবর্ষ উদযাপনের সেরা উপায়” বিষয়ক জুমুআর খুতবা প্রদান করেন। প্রদত্ত জুমুআর খুতবায় হযরত মসীহ্ মওউদ (আ.)-এর হাতে বয়আতকৃত আহমদীদের করণীয় এবং বিশেষত জার্মানিতে আহমদীয়াতের শতবর্ষ উপলক্ষ্যে সেখানকার আহমদীদের দায়দায়িত্ব সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করেন।


    তাশাহ্‌হুদ, তা’উয ও সূরা ফাতিহা পাঠের পর হুযূর (আই.) বলেন, আলহামদুলিল্লাহ্ চার বছরের বাধ্যবাধকতার পর আজ আহমদীয়া মুসলিম জামা’ত জার্মানির বার্ষিক জলসা বিশাল পরিসরে অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। আল্লাহ্ তা’লা সকল অংশগ্রহণকারীকে জলসায় আগমনের প্রকৃত উদ্দেশ্য অনুধাবনকারী বানান। অংশগ্রহণকারীরা এ বিষয়ে যেন সন্তুষ্ট না হয়ে যায় যে, আমাদের পুনরায় এখানে মিলিত হওয়ার সুযোগ হয়েছে তাই আমরা একত্রে বসে কিছু গল্পগুজব করি, পরস্পর সাক্ষাৎ করি; ব্যস! এটুকুই যথেষ্ট। জলসা আয়োজনের প্রধান যে উদ্দেশ্য হযরত মসীহ্ মওউদ (আ.) আমাদেরকে বলেছেন তা হলো, তাঁর হাতে বয়আতের মাধ্যমে জামা’তে অন্তর্ভুক্ত হয়ে ধর্মীয় জ্ঞানার্জন করা, আধ্যাত্মিকভাবে উন্নতি করা, আল্লাহ্ তা’লার সাথে নিবিড় সম্পর্ক স্থাপন ও ভালোবাসা বৃদ্ধি করা এবং মহানবী (সা.)-এর পরিপূর্ণ অনুসরণকারীদের অন্তর্ভুক্ত হওয়া, পার্থিব ভালোবাসাকে শীতল করা এবং ধর্মকে অগ্রগণ্য জ্ঞান করা। এ বিষয়গুলোকে স্মরণ রাখতে হবে।


    এরপর হুযূর (আই.) বলেন, এ বছর জার্মানিতে আহমদীয়া জামা’ত প্রতিষ্ঠিত হওয়ার শত বছর পূর্ণ হচ্ছে। এ বিষয়ে জার্মানির সদস্যরাও আনন্দিত। এটি অবশ্যই আনন্দের বিষয় যে আজ থেকে শত বছর পূর্বে প্রতিশ্রুত মসীহ্‌র মাধ্যমে ইসলামের অনিন্দ্য সুন্দর বাণী এদেশে পৌঁছেছিল। কিন্তু আমাদের আত্মজিজ্ঞাসা করা উচিত যে, এই শত বছরে আমরা কী অর্জন করেছি? আমরা আমাদের প্রতিশ্রুতি কতটুকু রক্ষা করেছি? এখানে যখন জামা’ত স্থাপিত হয়েছিল, তখন মাত্র হাতেগোণা কয়েকজন সদস্য ছিল। এরপর ধর্মীয় স্বাধীনতা লাভের উদ্দেশ্যে পাকিস্তানসহ অন্যান্য দেশের অনেক আহমদী এদেশে এসে বসতি স্থাপন করেছেন। কাজেই যেহেতু এখানে এসে ধর্মীয় স্বাধীনতা লাভ করেছেন তাই বিশেষ পরিশ্রমের মাধ্যমে নিজেদের অবস্থার পরিবর্তন করার চেষ্টা করা উচিত। আমরা যদি নিজেদের এবং নিজেদের সন্তানদের মধ্যে এই পবিত্র পরিবর্তন তৈরি করার চেষ্টা করে থাকি তবে সেটিই আমাদের পক্ষ থেকে আল্লাহ্ তা’লার প্রতি কৃতজ্ঞতাস্বরূপ হবে যা শতবর্ষ উপলক্ষ্যে আমাদের আদায় করা উচিত।


    হুযূর (আই.) বলেন, এ পর্যায়ে আমি হযরত মসীহ্ মওউদ (আ.)-এর কতিপয় উদ্ধৃতি উল্লেখ করব যা তিনি আমাদের হিদায়াতের লক্ষ্যে বর্ণনা করেছেন। তিনি (আ.) আমাদের বয়আতের উদ্দেশ্য উল্লেখ করে বলেন, এটি মনে কোরো না যে, কেবলমাত্র বয়আত করেই খোদার সন্তোষভাজন হয়ে যাবে। এটি তো কেবলমাত্র একটি রীতি। অতএব যে বয়আত করার ও ঈমান আনার দাবি করে তার আত্মজিজ্ঞাসা করা উচিত যে, আমি কি খোসা নাকি শাঁস? যতক্ষণ পর্যন্ত মগজ বা শাঁস তৈরি না হবে ততক্ষণ পর্যন্ত ঈমান, ভালোবাসা, আনুগত্য, বয়আত, বিশ্বাস এবং অনুসরণের দাবি প্রকৃত দাবি হবে না।


    ধর্মকে সর্বাবস্থায় জাগতিকতার ওপর প্রাধান্য দেওয়ার বিষয়ে হযরত মসীহ্ মওউদ (আ.) এক স্থানে বলেছেন, লক্ষ্য করো! দুই ধরনের মানুষ রয়েছে। এক প্রকার মানুষ ইসলাম গ্রহণ করার পর জাগতিক ব্যবসাবাণিজ্য ও কাজকর্মে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। শয়তান তাদের মাথায় ভর করে। আমার কথার অর্থ এটি নয় যে, ব্যবসা করা নিষেধ। পূর্বেও স্পষ্ট করা হয়েছে। সাহাবীরাও ব্যবসা করতেন, কিন্তু ধর্মকে জাগতিকতার ওপর প্রাধান্য দিতেন। তাঁরা ইসলাম গ্রহণ করার পর ইসলাম সম্বন্ধে প্রকৃত জ্ঞান অর্জন করেছেন যা তাদের হৃদয়কে আলোড়িত করেছে। এ কারণেই তাঁরা কোনো ক্ষেত্রেই শয়তানের আক্রমণে দোদুল্যমান হন নি। অতএব এটি প্রত্যেক আহমদীর জন্য নীতিগত আদর্শ। কোনো বিষয় তাদেরকে সত্য প্রকাশ থেকে বিরত রাখতে পারে নি। কারো বিষয়ে হস্তক্ষেপ করা উচিত নয়, কিন্তু নিজের ধর্ম বিশ্বাসকে লুকানোও উচিত নয়।


    অতঃপর হযরত মসীহ্ মওউদ (আ.) পবিত্র কুরআনের প্রতি গভীর অভিনিবেশের উপদেশ দিতে গিয়ে বলেন, যে ব্যক্তি জ্ঞান বৃদ্ধি করতে চায় তার উচিত মনোযোগের সাথে পবিত্র কুরআন অধ্যয়ন করা। কোনো তত্ত্বকথা যদি বুঝতে না পারেন তবে অন্যদের কাছে জিজ্ঞেস করে উপকৃত হোন। পবিত্র কুরআন একটি ধর্মীয় সমুদ্র যার স্তরে স্তরে অনেক দুর্লভ ও অমূল্য মণিমুক্তা বিদ্যমান। অতএব ধর্মীয় জ্ঞান অর্জনের জন্য পবিত্র কুরআনের পথনির্দেশনা গ্রহণ করা আবশ্যক এবং এই কুরআন করীম-ই প্রকৃত পথনির্দেশনা প্রদান করে। আর এ পদ্ধতিই ধর্মকে জাগতিকতার ওপর প্রাধান্য রাখার নির্দেশনা প্রদান করবে। অতএব আমাদের আত্মবিশ্লেষণ করা উচিত যে, কতজন রয়েছেন যারা মনোযোগ দিয়ে পবিত্র কুরআন পাঠ করেন, এটি তিলাওয়াত করেন এবং তারপর এর ওপর আমল করার চেষ্টা করেন। হুযূর (আই.) বলেন, অতএব পবিত্র কুরআন অনুধাবন করা অতি আবশ্যক। অধিকাংশ আহমদী অনেক প্রশ্ন করে। তারা যদি গভীর মনোনিবেশ সহ পবিত্র কুরআন পাঠ করে তাহলে তাতেই নিজেদের উত্তর পেয়ে যাবেন। বিভিন্ন অনুষ্ঠানে যখন পবিত্র কুরআনের বরাতে আলোচনা করা হয় তখন শ্রোতাবৃন্দ প্রভাবিত হয়। তারা ইসলামের শ্রেষ্ঠত্ব স্বীকার করে।


    আল্লাহ্ তা’লার সাথে সম্পর্ক স্থাপনের গুরুত্ব বর্ণনা করতে গিয়ে হযরত মসীহ্ মওউদ (আ.) বলেন, “আমার বিশ্বাস হলো, যে ব্যক্তি দৈবপাত থেকে নিরাপদ থাকতে চায় সে যেন খোদা তা’লার সাথে সন্ধি স্থাপন করে আর নিজের মাঝে এতটা পরিবর্তন সৃষ্টি করে যে, স্বয়ং উপলব্ধি করতে পারে যে, আমি সেই ব্যক্তি নই। খোদা তা’লা পবিত্র কুরআনে বলেন, অর্থাৎ নিশ্চয় আল্লাহ্ কখনো কোনো জাতির অবস্থার পরিবর্তন করেন না যতক্ষণ পর্যন্ত না তারা নিজেদের অবস্থার পরিবর্তন করে।


    তিনি (আ.) অন্যত্র বলেন, সত্য ধর্মের মূল হলো খোদার প্রতি ঈমান। খোদার প্রতি ঈমান প্রকৃত নেকী ও খোদাভীতি প্রত্যাশা করে। খোদা তা’লা মুত্তাকী (খোদাভীরু) ব্যক্তিকে বিনষ্ট করেন না। ঊর্ধ্বলোক থেকে তিনি তাকে সাহায্য করেন। ফিরিশ্তারা তাকে সাহায্য করার উদ্দেশ্যে অবতীর্ণ হন। মুত্তাকী ব্যক্তির মাধ্যমে মু’জিযা (অলৌকিক নিদর্শন) প্রকাশিত হয়- এর চেয়ে বড় বিষয় আর কী হতে পারে! মানুষ যদি খোদা তা’লার সাথে ষোলোআনা স্বচ্ছ হয় আর তাঁর অসন্তুষ্টিমূলক কাজকর্ম পরিহার করে তাহলে সে জেনে নিক যে, প্রতিটি কাজ কল্যাণমণ্ডিত হবে।


    হযরত মসীহ্ মওউদ (আ.) নামাযে স্বাদ না পাওয়ার কারণ এবং এর চিকিৎসা বর্ণনা করতে গিয়ে বলেছেন, “মোটকথা আমি দেখেছি, মানুষ নামাযে উদাসীন এবং অলস এ কারণে হয় যে, তারা এই স্বাদ এবং প্রশান্তি সম্পর্কে অবগত নয় যা আল্লাহ্ তা’লা নামাযের মাঝে নিহিত রেখেছেন এবং এর অন্যতম কারণ এটিই। পুনরায় শহরগুলোতে এবং গ্রামেও আরো বেশি অলসতা এবং উদাসীনতা পরিলক্ষিত হয়। মোটকথা পঞ্চাশভাগ মানুষও তো পরিপূর্ণ প্রস্তুতি এবং আন্তরিক ভালোবাসার মাধ্যমে স্বীয় খোদার সামনে অবনত হয় না। এরপর আবার প্রশ্ন জাগে যে, কেন তারা এই স্বাদ সম্পর্কে অবগত নয় আর কেন তারা কখনো এই স্বাদ লাভ করে নি? কখনো এমন হয় যে, আমরা কাজে লিপ্ত থাকি এবং মুয়াযযিন আযান দেয়। অথচ সে তা শুনতে চায় না, আযান শুনে যেন তারা কষ্ট পায় যে, আযান হয়ে গেছে; এখন তো নামাযের জন্য যেতে হবে। এমন চিন্তাধারার মানুষ অবশ্যই কৃপার যোগ্য। অনেক মানুষ এখানেও রয়েছে, যাদের দোকানগুলো দেখো! মসজিদের নিচে কিন্তু তারা নামাযে গিয়ে দাঁড়ায় না। তাই আমি এটি বলতে চাই যে, খোদা তা’লার পরম অত্যন্ত আবেগ ও অনুভূতির সাথে এই দোয়া করা উচিত যে, যেরূপভাবে ফলফলাদি এবং অন্যান্য বস্তুর নানা রকম স্বাদ আছে একবার আমাদের নামায এবং ইবাদতেও সেই স্বাদ প্রদান করো, যেন সেই স্বাদের কথা আমাদের স্মরণ থাকে।


    পরিশেষে হুযূর (আই.) বলেন, “জার্মানির আমীর সাহেব আমাকে কয়েকদিন ধরে জিজ্ঞেস করছেন, আমাদের আগামী শতাব্দীর টার্গেট কি হবে? প্রথম কথা হলো; আমি যে কয়েকটি বিষয়ের উল্লেখ করেছি আমরা কি বিগত শতাব্দীতে তা অর্জন করেছি? খোদা তা’লার সাথে আমাদের সম্পর্ক নিবিড় হয়েছে কি? আমাদের নামাযের উন্নত মান প্রতিষ্ঠা হয়েছে কি? আমরা কি নামাযের সময় পার্থিব কাজকর্মকে পরিত্যাগ করে নামাযে উপস্থিত হই নাকি কেবলমাত্র মসজিদ নির্মাণের প্রতি অধিক গুরুত্ব দিচ্ছি? আমরা কি নিয়মিত কুরআন তিলাওয়াত করছি? আমরা কি কুরআনের নির্দেশাবলী বের করে করে সেগুলোর ওপর আমল করার চেষ্টা করছি? আমরা কি সন্তানদেরকে ধর্মের সাথে সম্পৃক্ত করতে সর্বাত্মক চেষ্টা চালাচ্ছি? আমরা কি পারস্পরিক সম্পর্কের সেই মানে অধিষ্ঠিত হয়েছি যা সাহাবীদের ন্যায় দৃষ্টান্ত প্রদর্শন করে? আমরা কি উন্নত চরিত্র প্রদর্শনের মাধ্যমে অন্যান্যদের ইসলামের প্রতি আকৃষ্ট করতে সক্ষম হয়েছি? অতএব নিজেরা আত্মজিজ্ঞাসা করুন যে, হুকুকুল্লাহ্ এবং হুকুকুল ইবাদ তথা আল্লাহ্‌র ও বান্দার প্রাপ্য অধিকার প্রদানের মানদণ্ডে আমরা কতদূর অগ্রসর হয়েছি? আমরা যদি তা অর্জন করে থাকি, {হুযূর (আই.) বলেন, আমার মতে এখনো তা অর্জিত হয়নি} তাহলে আমাদের আগামী শতাব্দীর টার্গেট এই সংক্ষিপ্ত কর্মপদ্ধিতিই হবে যা হযরত মসীহ্ মওউদ (আ.)-এর রচনাসমগ্রের আলোকে আমি এখন বর্ণনা করেছি ।”


    হুযূর (আই.) বলেন, “আমরা তো এই দাবি করি যে, আমাদেরকে মানুষের হৃদয় জয় করতে হবে। আমরা বিশ্ববাসীকে খোদা তা’লার একত্ববাদের ছায়াতলে নিয়ে আসব। পৃথিবীবাসীকে মুহাম্মদ (সা.)-এর পদতলে সমবেত করব। অতএব উপরোক্ত উদ্ধৃতিগুলোর বরাতে আমাদের প্রত্যেকের আত্মজিজ্ঞাসা করা উচিত এবং নবপ্রতিজ্ঞার সাথে জামা’তে আহমদীয়া জার্মানির নতুন শতবর্ষে পদার্পণকরা উচিত যেন আমরা ধর্মকে জাগতিকতার ওপর প্রাধান্য দেওয়ার মাধ্যমে আমাদের এই লক্ষ্য অর্জনের পরিপূর্ণ চেষ্টা করি এবং নিজেদের সন্তানদের ও বংশধরদেরও এই তাগিদপূর্ণ নির্দেশ দিতে থাকব এবং তাদের এমনভাবে তরবীয়ত করবো যেন খোদা তা’লার সাথে নিবিড় সম্পর্কের এই চেতনা প্রজন্ম পরম্পরায় জারি থাকবে। আল্লাহ্ তা’লা আমাদেরকে এর তৌফিক দান করুন, আমীন।”

  • পুর্নাঙ্গ অনুবাদ
বিষয়ঃ
শেয়ার করুনঃ
অন্যান্য বিষয়ভিত্তিক খুতবা