بِسۡمِ اللّٰہِ الرَّحۡمٰنِ الرَّحِیۡمِِ
৬ আগস্ট, ২০২১
যুক্তরাজ্যের জলসায় আগত মেহমান এবং কর্মীদের দায়-দায়িত্ব – সালানা জলসা ২০২১
মসজিদ মুবারক, ইসলামাবাদ, টিলফোর্ড, লন্ডন
  • সারমর্ম
    এই জুমু’আর খুতবার সারাংশটিতে কোনো প্রকার ত্রুটি-বিচ্যুতি থাকলে তার দায়ভার আহ্‌মদীয়া বাংলা টীম গ্রহণ করছে।

    আহমদীয়া মুসলিম জামা’তের বিশ্ব-প্রধান ও পঞ্চম খলীফাতুল মসীহ্‌ হযরত মির্যা মসরূর আহমদ (আই.) গত ৬ই আগস্ট, ২০২১ইং অল্টনস্থ হাদীকাতুল মাহ্‌দী’র জলসা গাহ্‌ থেকে যুক্তরাজ্যের জলসায় আগত মেহমান এবং কর্মীদের দায়-দায়িত্ব সম্পর্কে জুমুআর খুতবা প্রদান করেন।

    তাশাহহুদ, তাআ’ব্বুয ও সূরা ফাতিহা পাঠের পর হুযূর (আই.) বলেন, আজ যুক্তরাজ্যের বার্ষিক জলসা আরম্ভ হতে যাচ্ছে, ইনশাআল্লাহ্। সর্বপ্রথম আমি বলতে চাই, এ দিনগুলোতে সার্বিক সফলতার সাথে জলসা সুসম্পন্ন হওয়ার জন্য আপনারা অনেক বেশি দোয়া করুন; আল্লাহ্ তা’লা এই দিনগুলোতে পূর্ণ ধর্মীয় পরিবেশ সৃষ্টি করে দিন এবং অংশগ্রহণকারীদের হৃদয়ে পুণ্য ও তাকওয়ার মান বৃদ্ধি করুন, (আমীন)। হুযূর বলেন, যদিও বর্তমানে বিশ্বব্যাপী মহামারীর কারণে এখানে অংশগ্রহণকারীদের সংখ্যা অত্যন্ত সীমিত, কিন্তু বাড়িতে বাড়িতে এবং বিভিন্ন স্থানে জামাতের ব্যবস্থাপনায় মসজিদ বা হলে জলসা দেখা ও দেখানোর ব্যবস্থা করা হয়েছে। এভাবে এমটিএ’র মাধ্যমে যারা-ই জলসায় অংশগ্রহণ করছেন, তারা যেন এই উপলদ্ধি নিয়েই জলসা দেখেন যে, তারাও জলসাগাহেই উপস্থিত রয়েছেন এবং তিনদিনই অনুষ্ঠান দেখবেন ও দোয়ায় ব্যাপৃত থাকবেন। হুযূর (আই.) বলেন, এই বছরের জলসা ব্যবস্থাপকদের জন্যও এবং অংশগ্রহণকারীদের জন্যও নতুন এক অভিজ্ঞতা, ফলে অতিথিদের জন্য নিয়ম মাফিক অনেক সুযোগ-সুবিধার আয়োজন করা সম্ভব হয় নি। হুযূর (আই.) জলসায় অংশগ্রহণকারীদেরকে উদ্ভূত পরিস্থিতি বিবেচনায় ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত ত্রুটি-বিচ্যুতি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখতে অনুরোধ করেন ও দোয়া করতে বলেন, যেন এরূপ সংকটময় পরিস্থিতি অচিরেই দূরীভূত হয় এবং জলসা পূর্বের মত জাঁকজমক ও ভাবগম্ভীর পরিবেশে উদযাপন করা যায়, (আমীন)। কোন কোন আহমদী সদস্য অভিযোগ করেছেন যে, বিভিন্ন শর্তের কারণে তাদেরকে জলসায় অংশগ্রহণের সুযোগ দেয়া হয় নি কিংবা অংশগ্রহণকারীদের নির্বাচন করার প্রক্রিয়া সঠিক ছিল না। হুযূর (আই.) অনুরোধ করেন, অভিযোগ সঠিক হোক বা ভ্রান্ত হোক- ব্যবস্থাপনার নতুনত্ব বিবেচনা করে তা উপেক্ষা করুন।

    এরপর হুযূর (আই.) জলসায় আগত অতিথি ও দায়িত্বে নিয়োজিত কর্মীদের উদ্দেশ্যে জলসা ও আতিথেয়তা সম্পর্কে বিভিন্ন মূল্যবান উপদেশ প্রদান করেন। স্বাভাবিক সময়ে হুযূর জলসার পূর্ববর্তী খুতবায় কর্মীদের এবং জলসার দিনের খুতবায় অতিথিদেরকে তাদের দায়িত্বাবলী স্মরণ করিয়ে থাকেন; এবার বিশেষ পরিস্থিতির কারণে আজকের খুতবাতেই উভয় পক্ষকে তাদের দায়-দায়িত্ব স্মরণ করান। প্রথমতঃ হুযূর (আই.) অতিথিসেবক ও কর্মীদের বলেন, “বিশেষ পরিস্থিতির কারণে আতিথেয়তায় কোন ত্রুটি বা ব্যত্যয় হওয়া উচিত নয়। এ বছর অংশগ্রহণকারীর সংখ্যা অনেক অল্প বলে বা বিদেশী অতিথিরা অংশ নিচ্ছে না বলে দায়িত্ব সহজ ভেবে শৈথিল্য দেখানোর কোন সুযোগ নেই; মনে রাখবেন কাছের মানুষরাই অনেক সময় বেশি কষ্ট বা দুঃখ পেয়ে থাকে। যুক্তরাজ্যের জলসার কর্মীগণ, তারা খোদ্দাম, আতফাল, লাজনা, নাসেরাত বা আনসার যে সংগঠনের সদস্যই হোক না কেন- তারা সবাই নিজেদের দায়িত্বের ব্যাপারে যথেষ্ট দক্ষতা অর্জন করেছে, নতুনদেরও ভালোভাবে প্রশিক্ষণ দিতে তারা সমর্থ; কিন্তু যেহেতু আল্লাহ্ তা’লার নির্দেশ হল, মু’মিনদেরকে স্মরণ করানো উচিত, তা সর্বদা তাদের জন্য উপকারী সাব্যস্ত হয়ে থাকে”, তাই হুযূর (আই.) স্মরণ করান যে, “ছোট্ট পরিসরে হলেও অতিথিদের শেখানোর জন্য এবং নবাগত কর্মীদের শেখানোর জন্য প্রতিটি কাজই সুচারুরূপে সম্পন্ন করা একান্ত গুরুত্বপূর্ণ। প্রতিটি বিভাগের কর্মীদের মনে রাখতে হবে, জলসায় আগত অতিথিরা সংখ্যায় অল্প হোন বা বেশি হোন- তাঁরা সবাই হযরত মসীহ্ মওউদ (আ.)-এর অতিথি; তাঁদের যথাসাধ্য আপ্যায়ন করা আমাদের কর্তব্য। আতিথেয়তা নবীদের ও তাঁদের জামাতের এক অনন্য বৈশিষ্ট্য। ধর্মীয় জামাত হওয়ার কারণে আমাদের আতিথেয়তার এক বিশেষ ও সুস্পষ্ট মানদণ্ড থাকা আবশ্যক”। হুযূর (আই.) প্রাসঙ্গিকভাবে মহানবী (সা.)-এর যুগে সাহাবীদের আদর্শের উল্লেখ করেন এবং এই যুগে হযরত মসীহ্ মওউদ (আ.)-ও নিজ জামাতকে সেই আদর্শ অনুসরণের জন্য যে জোরালো উপদেশ দিয়েছেন তা পুনর্ব্যক্ত করেন। হযরত মসীহ্ মওউদ (আ.) এ প্রসঙ্গে বলেছেন, কোন অতিথি যদি কঠোরতা ও অসদাচরণও প্রদর্শন করে, তবুও তা সহ্য করতে হবে এবং তাঁদের সাথে নম্র ব্যবহার করতে হবে। তিনি (আ.) স্বয়ং কীভাবে নিজের অনুসারীদেরও আতিথেয়তা করেছেন সে সংক্রান্ত বিভিন্ন ঘটনা হুযূর উল্লেখ করেন। তিনি (আ.) বলতেন, “অতিথির হৃদয় আয়নার মত স্পর্শকাতর হয়ে থাকে, সামান্য আঘাতেই তা ভেঙে যেতে পারে”। অতিথিশালার ব্যবস্থাপককে তিনি (আ.) একবার উপদেশ দিয়ে বলেন, “অতিথি পরিচিত বা অপরিচিত যেই হোক না কেন- প্রত্যেকেরই অত্যন্ত সম্মানের সাথে আতিথেয়তা করতে হবে”। হুযূর (আই.) বলেন, “এটিই আতিথেয়তার মূলনীতি। কোন কোন বিভাগের কর্মীদের কতিপয় অতিথি কর্তৃক কঠোর আচরণের সম্মুখীন হতে হয়, কিন্তু আমাদের কখনোই সদ্ব্যবহার বিসর্জন দেয়া চলবে না, সর্বদা সদাচরণ প্রদর্শন করতে হবে। এবছর বেশ কিছু নিয়ম-কানুন কঠোরভাবে পালন করতে হবে- যেমন, সর্বদা মাস্ক পরিধান করা, সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা, খাওয়ার সময়ও দূরত্ব বজায় রাখা ইত্যাদি। সাধারণভাবে সবাই নিয়ম মেনেই চলেন, সমস্যা দু’একজনই সৃষ্টি করে; এরূপ পরিস্থিতিতে যদি কর্মীদের পক্ষ থেকেও রূঢ়তা প্রদর্শিত হয় তাহলে পরিস্থিতি আরও খারাপ হওয়ার আশংকা থাকে। তাই কাউকে বুঝাতে হলে একান্ত ধৈর্য ও নম্রতার সাথে বুঝাতে হবে। মহানবী (সা.) বলেছেন, “মু’মিনের একটি বৈশিষ্ট্য হল, সে অতিথিকে সম্মান করে”; এই মু’মিনসুলভ বৈশিষ্ট্য প্রত্যেকের মধ্যে সৃষ্টি হওয়া প্রয়োজন”।

    হুযূর (আই.) বলেন, “পারস্পরিক সহযোগিতার মাধ্যমেই আমাদের কাজ সহজসাধ্য ও সুন্দর হওয়া সম্ভব। অতিথিদেরও একথা স্মরণ রাখা উচিত, ইসলাম একদিকে যেমন অতিথিদের সম্মান করার উপদেশ দিয়েছে, সেইসাথে অতিথিকেও বেশকিছু উপদেশ মেনে চলার নির্দেশ দিয়েছে। অতিথিকে উপদেশ দেয়া হয়েছে- কারও বাড়িতে গেলে জানিয়ে যেও; যদি বাড়ির কর্তা তোমাদের ফিরে যেতে বলে তবে বিনা বাক্য-ব্যয়ে ফিরে এসো। জলসার অতিথিদের ক্ষেত্রে সাধারণতঃ একথা প্রযোজ্য হয় না, কিন্তু এ বছর মহামারীর কারণে বয়স, সুস্থতা ইত্যাদি সংক্রান্ত কিছু শর্ত আরোপ করা হয়েছে। সেসব শর্ত পূর্ণ না হলে জোর করে জলসায় অংশগ্রহণের চেষ্টা করা অনুচিত। জোর করে অংশগ্রহণের চেয়ে যে নিয়ম করা হয়েছে- সেটি পালন করা অধিক পবিত্রতা ও মঙ্গলের কারণ হবে, যা জলসায় যোগদানের অন্যতম উদ্দেশ্য”। যাদের অংশগ্রহণ করতে না পারার কারণে মন খারাপ হচ্ছে তাদেরকে হুযূর (আই.) অধিক ব্যাকুলতার সাথে দোয়া করতে বলেন যেন আল্লাহ্ তা’লা দ্রুত পরিস্থিতি স্বাভাবিক করে দেন এবং তারা স্বচ্ছন্দে জলসায় অংশগ্রহণ করতে পারেন।

    হুযূর (আই.) এটিও স্মরণ করান, যারা জলসায় অংশগ্রহণের অনুমতি পেয়েছেন তাদের স্মরণ রাখা উচিত- একান্ত অপারগতা ছাড়া তারা যেন জলসায় অনুপস্থিত না থাকেন। তারা যেন সেই আহমদীদের স্মরণ করেন যারা একান্ত আগ্রহ থাকা সত্ত্বেও জলসায় যোগদানের সুযোগ পান নি; যদি অনুমতি পাওয়ার পরও আপনারা না আসেন, তবে তাদের অধিকার ক্ষুন্ন করা হবে যারা অনুমতি পান নি। তাই বৈরি আবহাওয়াকে কেউ যেন অজুহাত না বানান। কাদিয়ান ও রাবওয়ার জলসায় মানুষজন কীভাবে তীব্র শীত, এমনকি বৃষ্টি সত্ত্বেও জলসার অনুষ্ঠান মনোযোগ নিয়ে শুনতেন, এমনকি যুক্তরাজ্যেও অতীতে মানুষ জলসার সময় কাদাপানিতে দাঁড়িয়েও নামায পড়েছেন, যাদের মধ্যে হুযূর (আই.) নিজেও অন্তর্ভুক্ত ছিলেন- সেকথা স্মরণ করান।

    হুযূর (আই.) সকলকে ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত কিছু নির্দেশনাও স্মরণ করান; খাবারের তাঁবুতে দূরত্ব বজায় রাখা, খাওয়ার সময় ব্যতিরেকে অন্যান্য সময় মাস্ক পরিধান করে থাকা, জলসা চলাকালীন স্লোগান দেয়ার সময়ও অবশ্যই মাস্ক পরিধান করে থাকা, চেকিংয়ের সময় বিরক্তি প্রকাশ না করা ও প্রয়োজনীয় সব কাগজপত্র প্রদর্শন করা এবং স্মরণ রাখা যে, এসব নিয়ম অতিথিদের নিরাপত্তার স্বার্থেই করা হয়েছে, তেমনিভাবে নিরাপত্তার বিষয়েও সর্বদা সজাগ থাকা ইত্যাদি। বরাবরের মতই হুযূর (আই.) মনোযোগের সাথে জলসার কার্যক্রম শোনার বিষয়টি পুনরায় স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলেন, “জলসা শুনতে এসেছেন, জলসা শুনুন। দীর্ঘদিন পর দেখা হয়েছে- এই কারণে নিজেরা বসে গল্পগুজবে মত্ত হবেন না; সারাক্ষণ দোয়া ও যিকরে ইলাহীতে রত থাকুন”। জলসার সময় যিকরে ইলাহীতে রত থাকার বিষয়ে হযরত মুসলেহ্ মওউদ (রা.) পবিত্র কুরআনের আলোকে বলেন, “যারা যিকরে ইলাহীতে রত থাকে, আল্লাহ্ তাদেরকে স্মরণ রাখেন। আল্লাহ্ বান্দাকে স্মরণ করবেন”- বান্দার জন্য এর চাইতে সৌভাগ্যের আর কী হতে পারে?! হুযূর (আই.) বলেন, পৃথিবীময় আহমদীরা যেখানেই বসে জলসা দেখছেন, তাদের সবাইকে এ দিনগুলো যিকরে ইলাহীতে রত থাকার নির্দেশ দেন এবং এভাবে আল্লাহ্ তা’লার কৃপারাজি অর্জন, নিজেদের আধ্যাত্মিক অবস্থার উন্নতি সাধন ও পার্থিব বিপদাপদ থেকে রক্ষা পাবার উপদেশ প্রদান করেন। শেষের দিকে জলসার কার্যক্রম মনোযোগের সাথে শোনার ব্যাপারে হযরত মসীহ্ মওউদ (আ.)-এর একটি উদ্ধৃতিও হুযূর উপস্থাপন করেন। তিনি (আ.) জলসায় অংশগ্রহণকারীদেরকে মনোযোগ সহকারে জলসা শোনার উপদেশ দেন এবং বলেন, “বক্তা কেমন জাদুকরি বক্তব্য উপস্থাপন করছে, কত সুন্দর শব্দচয়ন- সেটিই যেন আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু না হয়। যে কাজই করা হয় তা যেন আল্লাহ্ তা’লার খাতিরে করা হয়, যা-ই বলা হয় তা যেন আল্লাহ্‌র খাতিরে বলা হয়”- এটি ছিল তাঁর (আ.) প্রকৃতিগত বৈশিষ্ট্য; আর নিজ জামাতকেও তিনি (আ.) এটিই অবলম্বন করতে বলেছেন। পূর্ণ মনোযোগ, নিষ্ঠা ও আন্তরিকতা নিয়ে জলসা শোনার বিষয়ে তিনি (আ.) জোরালো নির্দেশ দিয়েছেন। হুযূর (আই.) বলেন, এটি তখনই অর্জন করা সম্ভব যখন আল্লাহ্‌র সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য আমাদের হৃদয়ে এক ব্যাকুলতা থাকবে। হুযূর (আই.) দোয়া করেন, আল্লাহ্ করুন, আমরা প্রত্যেকেই যারা জলসায় অংশগ্রহণ করছি বা জলসা শুনছি, তারা যেন নিজেদের ভেতর খাঁটি নিষ্ঠা ও বিশ্বস্ততা সৃষ্টি করতে পারি। আবহাওয়ায় আনুকূল্য সৃষ্টি হওয়ার জন্যও হুযূর (আই.) দোয়া করেন, যেন তা আমাদের কোন কাজে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি না করে এবং আমাদের অনুকূলে এসে যায়। [আমীন]

  • পুর্নাঙ্গ অনুবাদ
বিষয়ঃ
শেয়ার করুনঃ
অন্যান্য বিষয়ভিত্তিক খুতবা