بِسۡمِ اللّٰہِ الرَّحۡمٰنِ الرَّحِیۡمِِ
১০ মার্চ, ২০২৩
প্রতিশ্রুত মসীহ্‌ ও ইমাম মাহদী (আ.)-এর দৃষ্টিতে পবিত্র কুরআনের অতুলনীয় মর্যাদা ও শহীদ জাহিদ হাসান সাহেবের স্মৃতিচারণ
মসজিদ মুবারক, ইসলামাবাদ, টিলফোর্ড, যুক্তরাজ্য
  • সারমর্ম
    এই জুমু’আর খুতবার সারাংশটিতে কোনো প্রকার ত্রুটি-বিচ্যুতি থাকলে তার দায়ভার আহ্‌মদীয়া বাংলা টীম গ্রহণ করছে।

    আহ্‌মদীয়া মুসলিম জামা’তের বিশ্ব-প্রধান ও পঞ্চম খলীফাতুল মসীহ্‌, আমীরুল মু’মিনীন হযরত মির্যা মসরূর আহমদ (আই.) গত ১০ই মার্চ, ২০২৩ ইসলামাবাদের মসজিদে মুবারকে প্রদত্ত জুমুআর খুতবায় বিগত খুতবার ধারাবাহিকতায় প্রতিশ্রুত মসীহ্‌ ও ইমাম মাহদী (আ.)-এর রচনাসমগ্র থেকে পবিত্র কুরআনের অনিন্দ্য সুন্দর গুণাবলী, বৈশিষ্ট্য ও মাহাত্ম্য বর্ণনা করেন। খুতবার শেষাংশে হুযূর (আই.) বাংলাদেশে জলসায় শহীদ জাহিদ হাসান সাহেবের স্মৃতিচারণ করেন। এরপর হুযুর (আই.) আরো চারজন প্রয়াত ব্যক্তির স্মৃতিচারণ করেন। প্রথমে রয়েছেন আলজেরিয়ার কামাল ভাদা সাহেব, এরপর রয়েছেন, লাহোরের শহীদ মাকসুদ আহমেদ মালিক সাহেবের স্ত্রী ড. শামীম মালিক সাহেবা, পরবর্তীতে রয়েছেন, জার্মানির শাহাব আহমদ আমিনি সাহেবের ছেলে ফরহাদ আহমদ ও সবশেষে রয়েছেন কানাডার চৌধুরী জাভেদ আহমেদ বিসমিল সাহেব। হুযূর (আই.) নামাযান্তে তাদের সকলের গায়েবানা জানাযা পড়ান।


    পবিত্র কুরআনের সৌন্দর্য ও অসাধারণ বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করতে গিয়ে হযরত মসীহ্ মওউদ (আ.) বলেন, পবিত্র কুরআন এমন এক পরিপূর্ণ গ্রন্থ অন্য কোনো গ্রন্থ এর প্রতিদ্বন্ধিতা করতে পারে না। পবিত্র কুরআন সীরাতে মুস্তাকিমের দোয়া শিখিয়েছে, এরপর এ ঘোষণা করেছে যে, পবিত্র কুরআনের অনুসরণের মাধ্যমে কোনো ব্যক্তি সঠিক পথ লাভ করতে পারবে। আফসোস! মানবজাতি এ বিষয়ে উদাসীন এবং এ থেকে দূরে অবস্থান করে এর কল্যাণ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।


    যে যুগে মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)-কে প্রেরণ করা হয়েছে তাও পবিত্র কুরআনের সত্যতার একটি প্রমাণ। তার প্রতি অবতীর্ণ কিতাব পশুতুল্য মানুষকে বিবেকবান মানুষে এবং বিবেকবান মানুষকে পুণ্যবান মানুষে পরিণত করেছে। এটি কিতাবুল্লাহ বা কুরআনের কামেল গ্রন্থ হওয়ার একটি বিরাট প্রমাণ। অন্যান্য গ্রন্থের বিপরীতে এমন কোনো সত্যতা নেই যা কুরআনে পাওয়া যায় না। কিন্ত মুসলমানদের প্রতি আফসোস! তারা কুরআনের প্রতি সত্যিকার অর্থে অভিনিবেশ করেই না।


    হযরত মসীহ্ মওউদ (আ.) পবিত্র কুরআনের শ্রেষ্ঠত্ব ও জুমুআর গুরুত্ব সম্পর্কে বলেন, মোটকথা **الْيَوْمَ أَكْمَلْتُ لَكُمْ دِينَكُمْ** আয়াতটির দুটি দিক রয়েছে। একটি হলো, তোমাদের পরিশুদ্ধ করেছি। অর্থাৎ তোমাদেরকে পবিত্র করে দিয়েছি। দ্বিতীয়ত কিতাব সম্পূর্ণ করেছি। অর্থাৎ পরিপূর্ণ শরীয়ত তথা জীবনবিধান তোমাদের প্রতি অবতীর্ণ করেছি। বলা হয় যে, যখন এই আয়াত অবতীর্ণ হয় সেটি ছিল জুমুআর দিন। হযরত উমর (রা.)-কে কোনো এক ইহুদী বলে, এই আয়াত অবতীর্ণ হওয়ার দিনে তো তোমাদের ঈদ করা উচিত ছিল। উত্তরে হযরত উমর (রা.) বলেন, জুমুআ তো ঈদই। কিন্তু বহু মানুষ এই ঈদ সম্পর্কে অনবগত। অন্যান্য ঈদে তারা নতুন কাপড়-চোপড় পড়ে কিন্তু এই ঈদের প্রতি ভ্রুক্ষেপ না করে পুরোনো কাপড় পরেই চলে আসে। এখানে তিনি জুমুআর গুরুত্বও স্পষ্ট করেন যে, জুমুআর নামায পড়া কতটা গুরুত্বপূর্ণ। তিনি (আ.) বলেন, আমার মতে এই ঈদ অন্যান্য ঈদের চেয়েও উত্তম। অর্থাৎ জুমুআর নামাযে অংশ নেয়ার জন্য বিশেষ ব্যবস্থা এবং আয়োজন করা উচিত। শুধু বছর শেষে ঈদের নামায পড়াই যথেষ্ট নয়। এই ঈদের জন্যই সূরা জুমুআ রয়েছে আর এর জন্যই নামায কসর করা হয়েছে। এছাড়া জুমুআ হলো সেটি যাতে আসরের সময় আদমের জন্ম হয়েছে আর এই ঈদ এই যুগেরও প্রমাণ বহন করে যে, প্রথম মানব এই ঈদেই জন্ম নিয়েছে। পবিত্র কুরআন অবতীর্ণ হওয়া এই দিনেই শেষ হয়েছে।


    এছাড়াও হুযূর (আই.) হযরত মসীহ্ মওউদ (আ.)-এর বিভিন্ন উদ্ধৃতির আলোকে পবিত্র কুরআনের অনিন্দ্য সুন্দর গুণাবলী তুলে ধরেন, পবিত্র কুরআন হাদীসের ওপর বিচারক, পবিত্র কুরআনের বাগ্মিতা ও ভাষাশৈলী অনন্য ও অসাধারণ, কুরআন শরীফ একটি সহজবোধ্য কিতাব এবং এটি জীবন্ত খোদাকে উপস্থাপন করে।


    খুতবার এ পর্যায়ে হুযূর (আই.) বলেন, এ বিষয়ে আগামীতেও বর্ণনা করা হবে ইনশাআল্লাহ্। আল্লাহ্ তা’লা আমাদেরকে এ বিষয়গুলো অনুধাবনের এবং কুরআনের শিক্ষামালার ওপর আমল করার তৌফিক দান করুন।


    খুতবার শেষদিকে হুযূর (আই.) বলেন, যেভাবে আমরা জানি, গত শুক্রবারে বাংলাদেশে জলসা হচ্ছিল আর জলসার চলাকালীন সময় দাঙ্গাবাজ ও সন্ত্রাসীরা সেখানে আক্রমণ করে। পুলিশ এবং প্রশাসনের পক্ষ থেকে আগেই একথা বলে আশ্বস্ত করে হয়েছিল যে, তারা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখবে আর কিছুই হবে না, তাই আপনারা জলসা করুন। কাজেই জলসার (কার্যক্রম) চলতে থাকে কিন্তু (বিরুদ্ধবাদী) লোকেরা এলে পুলিশ সেখানে নিরব দর্শক হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে আর এভাবে কয়েক ঘন্টা অতিবাহিত হওয়ার পর তারা যখন ওপর থেকে নির্দেশপ্রাপ্ত হয় তখন তারা পদক্ষেপ নেয়। কিন্তু তখন পর্যন্ত অনেক কিছু ঘটে গিয়েছিল। যাহোক, সেই অরাজকতায় আমাদের এক ভাই প্রিয় জাহিদ হাসান সাহেব শহীদ হয়। তিনি বাংলাদেশের আবু বকর সিদ্দীক সাহেবের পুত্র ছিলেন, **إنّا لله وإنّا إليهِ رَاجعُون।**


    হুযূর (আই.) বলেন, ন্যাশনাল আমীর, আব্দুল আউয়াল সাহেব লিখেছেন, পঞ্চগড় জেলার আহমদনগরে অনুষ্ঠিত জলসায় জাহিদ হাসান সাহেব গেট ও সীমানা প্রাচীর প্রহরা দেয়ার সময় বিরুদ্ধবাদীদের আক্রমণের ফলে ২৫ বছর বয়সে শাহাদত বরণ করেন, **إنّا لله وإنّا إليهِ رَاجعُون।** মরহুম ২০১৯ সনে বয়আত করেছিলেন আর এর ৩ মাস পরেই ওসীয়্যতের জন্য আবেদন করেছিলেন। তার পরিবারের সদস্যরা আহলে হাদীস ফির্কার সদস্য। আহমদীয়াত গ্রহণের পরই শহীদ মরহুম তার পিতামাতাকে তবলীগ করতে আরম্ভ করেন যার ফলে ২০২০ সনে তার পিতামাতাও বয়আত করার সৌভাগ্য লাভ করেন। বয়আত করার পর থেকেই শহীদ মরহুম নিয়মিত আমাকে পত্র লিখতেন।


    হুযূর (আই.) বলেন, শহীদ মরহুমের আহমদী হওয়ার ঘটনাটি হলো, তার এক সহপাঠী মুহাম্মদ রিফাত হাসান শিশির বগুড়া শহরের পুন্দ্রা ইউনিভারর্সিটি অফ সাইন্স এন্ড টেকনোলজিতে পড়াশোনা করতেন। তারা দুজন সাইন্স এণ্ড টেকনোলজিতে বিএসসি করছিলেন। তখন সেই আহমদী যুবক বন্ধু তাকে তবলীগ করেন আর দুই বছর তবলীগ করার পর তার কাছে যখন আহমদীয়াতের সত্যতা স্পষ্ট হয়ে যায় তখন তিনি বয়আত করেন। আউয়াল সাহেব আরো লিখেন, জলসার শুরুতেই জলসা গাহের চতুর পাশ থেকে মোল্লারা তাদের দলবল নিয়ে জলসা গাহের প্রাচীর ও পশ্চিম দিকের গেটে আক্রমণ করতে থাকে। ইটপাটকেল নিক্ষেপের পাশাপাশি দেশীয় অস্ত্রশস্ত্র যেমন, কুঠার, লাঠিসোঁটা ইত্যাদি নিয়ে এসব লোক আক্রমণ চালায় এবং যেখানেই সুযোগ পায় অগ্নিসংযোগ করতে থাকে। জামাতের যুবকরা অত্যন্ত সাহসিকতার সাথে তাদের দায়িত্ব পালন করছিল। যারা দায়িত্বে নিয়োজিত ছিল তাদের ছাড়া সাধারণভাবে অন্য কারো বাইরে যাওয়ার অনুমতি ছিল না। সবলোক ও খোদ্দাম ভেতরেই ছিল আর ভেতর থেকেই নিরাপত্তা বিধান করছিল। জলসা শুরু হওয়ার পৌনে দুই ঘন্টা পর আক্রমণকারীরা দেয়ালের একাংশ ভেঙ্গে ফেলতে সক্ষম হলে খোদ্দামকে যেকোনো মূল্যে প্রাচীর ও জলসা গাহের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে নির্দেশ দেয়া হয়। তখন এক নম্বর গেটে নিয়োজিত শহীদ জাহিদ হাসান তার সঙ্গীদের নিয়ে গেট থেকে বের হয়ে জলসা গাহে আক্রমণকারীদের তাড়িয়ে দেয়ার উদ্দ্যেশে অত্যন্ত দ্রুতগতিতে এবং সাহসিকতার সাথে (ঘটনাস্থলে) গিয়ে পৌঁছেন। এরই ফাঁকে একটি সময় এমন আসে যখন তিনি সন্ত্রাসীদের মোকাবিলা করতে করতে সঙ্গীদের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন। তাই সুযোগ পেয়ে আক্রমণকারীরা তাকে ঘিরে ফেলে। তার মাথার পিছনে কুঠার অথবা অন্য কোনো ধারালো অস্ত্র দিয়ে আক্রমণ করে আর তাকে টেনে-হেঁচরে কিছুটা দূরে নিয়ে যায়। তার মুখমণ্ডল এবং শরীরের বিভিন্ন অংশে অত্যন্ত নির্মম ও পৈশাচিক আক্রমণ করে পশুত্বের পরিচয় দিয়েছে। শহীদ মরহুম জাহিদ হাসান সাহেবকে এতটা নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে যে, তাকে শনাক্ত করতেই দু’ঘন্টা সময় লেগে যায়। এই হলো এসব মুসলমানদের অবস্থা। আল্লাহ্ এবং রসূলের নামে অত্যাচার ও বর্বরতার চূড়ান্ত করেছে। মহানবী (সা.) তো যুদ্ধের মাঝে শত্রুদের, অর্থাৎ কাফিরদের লাশ বিকৃত করতেও বারণ করেছেন; কিন্তু এরা আল্লাহ্ এবং রসূলের প্রতি বিশ্বাস স্থাপনকারীদের সাথে এমন আচরণ করে। আল্লাহ্ই রয়েছেন যিনি এদের পাকড়াও করার ব্যবস্থা করবেন এবং এরপর তাদের ধ্বংস করবেন। তাঁর ডিউটির আইডেনটিটি কার্ডও হন্তারকরা ছিড়ে ফেলেছিল, বুক থেকে খুলে ফেলেছিল। কিন্তু তিনি যেহেতু খোদ্দামের ডিউটির পোশাক পরিহিত ছিলেন এজন্য কিছু না কিছু চেনা যাচ্ছিল। যাহোক, তার লাশ উদ্ধার করার পর তাহাজ্জুদ ও ফজরের নামাযের পর শহীদের জানাযার নামায আদায় করা হয়। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে জলসায় অংশগ্রহণ করা হাজার হাজার মানুষ এতে অংশগ্রহণ করেন। জানাযার নামাযের সময় উপস্থিত সবার মাঝে যে অবস্থা সৃষ্টি হয়েছিল তার কোনো তুলনা হয় না। সেখানে অত্যন্ত আবেগঘন পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছিল। সবাই খোদার দরবারে আহাজারি করছিল। আইনী বাধ্যবাধকতা থাকার কারণে এরপর লাশের ময়নাতদন্ত করা হয় এবং দুপুরের পর কাফেলার সাথে শহীদ মরহুমের মরদেহ তাঁর পৈত্রিক গ্রামের উদ্দেশ্যে এম্বুলেন্সে করে পাঠানো হয়। সেখানে রাত দশটায় তাঁকে সমাহিত করা হয়।


    শহীদ মরহুমের ঘনিষ্টতম বন্ধু স্নেহের রিফাত হাসান সাহেব বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালে তার সাথে বন্ধুত্ব হয়। প্রকৃতিগতভাবেই তিনি অত্যন্ত ভদ্র ছিলেন, কিন্তু ইবাদতের প্রতি আকর্ষণ কম ছিল। কিন্তু আহমদীয়াত গ্রহণ করার পর তার মাঝে আমূল পরিবর্তন আসে এবং বাজামাত নামাযে অভ্যস্ত হয়ে যান। তিনি অত্যন্ত বিনয়ী, নম্র ও বিনীত একজন যুবক ছিলেন। তিনি বলেন, পাঁচ বছরের মধ্যে আমি কখনোই তাকে কারো সাথে উঁচু স্বরে কথা বলতে শুনি নি। তার সৌভাগ্যের পরিচয় এভাবেও পাওয়া যায় যে, বয়আত করার কয়েক মাস পরেই তিনি ওসীয়্যত করার সৌভাগ্য লাভ করেন। তিনি বলেন, স্নেহের শহীদ জাহিদ হাসান খোদ্দামুল আহমদীয়ার সক্রিয় কর্মী ছিলেন। শাহাদতের সময়ে তিনি ঢাকা ও বরিশাল রিজিওনের খোদ্দামুল আহমদীয়ার মোতামাদ হিসেবে দায়িত্ব পালনের সৌভাগ্য লাভ করছিলেন। এছাড়াও তিনি ঢাকার মতিঝিল হালকার যয়ীমও ছিলেন।


    এই মজলিসের কায়েদ এবং মোহতামীম মোকামী জনাব জহুরুল ইসলাম সাহেব বলেন, তিনি মজলিসের কাজে অত্যন্ত একাগ্রচিত্ত এবং নিজের সিনিয়রের অনুগত ছিলেন। অর্পিত দায়িত্ব গভীর আগ্রহের সাথে পালন করতেন। সর্বদা প্রথমে সালাম দিতেন। সব সময় হাস্যোজ্জল থাকতেন। এক-দেড় বছর পূর্বে তিনি বিএসসি.পাশ করার পর একটি কোম্পানীতে চাকরি শুরু করেন। চাকরির সুবাদে কখনো যদি ঢাকা থেকে দূরে কোথাও যেতে হতো তখন সুযোগ সুবিধা অনুযায়ী নিকটবর্তী মজলিসগুলো সফর করতেন। তার ফেসবুক একাউন্টের ব্যক্তিগত প্রোফাইলে **وَمَنْ يَتَوَكَّلْ عَلَى اللَّهِ فَهُوَ حَسْبُهُ** – এ আয়াতের অনুবাদ লেখা রয়েছে।


    শরীফ আহমদ সাহেব মুরব্বী সিলসিলাহ্ বলেন, আমি তখন তেবাড়িয়া জামা’তে নিযুক্ত ছিলাম যখন শহীদ মরহুম তার বন্ধু রিফাত হাসান সাহেবের সাথে যেরে তবলীগ হিসেবে সেখানে উপস্থিত হয়েছিলেন। তিনি বয়আত করার আগ্রহ প্রকাশ করলে আমি তাকে বলি, আপনি আরো সময় নিন, ভালোভাবে যাচাই বাছাই করুন। তিনি বলেন, যদিও আমি এই জামা’তের সত্যতার ব্যাপারে নিশ্চিত তথাপি আপনার কথামত পরবর্তীতে এসে বয়আত করব। অতএব এরপরের বার তিনি বয়আত করেন। তিনি, অর্থাৎ মুরব্বী সাহেব বলেন, বয়আত করার পর তিনি আহমদীয়াত এবং খিলাফত ব্যবস্থাকে উপলব্ধি করার জন্য পুরোদমে চেষ্টা প্রচেষ্টা করতে আরম্ভ করেন। (জামাত সম্পর্কে) গভীর জ্ঞান আহরণ করেন। যেমনটি আমি বলেছি, আমাকেও নিয়মিত পত্র লিখতেন। জলসায় যাওয়ার সময় তিনি সর্বশেষ যে পত্র লিখেন তাতে তিনি লিখেন, “আমরা ট্রেনে করে জলসায় যাচ্ছি আর শত্রুদের ষড়যন্ত্র অত্যন্ত ভয়ঙ্কর, অনেক স্থানে তারা অগ্নিসংযোগও করেছে কিন্তু আমরা জলসা করব, ইনশাআল্লাহ্”। এছাড়া তিনি তার ঈমানের কথা ব্যক্ত করেন আর এ প্রত্যাশাও ব্যক্ত করেন যে, “আমার আত্মীয়স্বজন ও গ্রামের সব মানুষ যেন আহমদী হয়ে যায়, গোটা গ্রাম যেন আহমদী হয়ে যায়”। এটি ছিল তার শেষ চিঠি যা তিনি লিখেছিলেন।


    একজন খাদেম লিখেন, শহীদ মরহুম এমন বিনয়ী কর্মী ছিলেন যে, তাকে কেউ কোনো কাজ দিলে তিনি না করতেন না। তিনি বলেন, কখনো কখনো আমি মজা করে বলতাম, আমরা যদি এতো কাজ করি তাহলে তো আমরা শেষ হয়ে যাব। একথা শুনেও সব সময় হেসে উঠতেন। শহীদ মরহুম ওসীয়্যতকারীও ছিলেন। তিনি বলেন, “(একবার) আমি তাকে জিজ্ঞেস করি, আপনার এত তাড়াতাড়ি ওসীয়্যত করার কারণ কী”? উত্তরে তিনি বলেন, “ইমাম মাহদী সত্য ছিলেন, তাই তিনি (আ.) যা কিছু বলেছেন তা-ও সত্য। হযরত মসীহ্ মওউদ (আ.) ওসীয়্যত করতে নির্দেশ দিয়েছেন, তাই আমি ওসীয়্যত করেছি”। তিনি বলেন, “আমি তার কথা শুনে বিস্মিত হয়ে যাই যে, হযরত মসীহ্ মওউদ (আ.)-এর প্রতি তিনি কত গভীর ঈমান রাখেন!” তিনি আরো বলেন, শহীদ মরহুমকে একবার তার আহমদীয়াত গ্রহণের মূল কারণ জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন, ইমাম মাহদী বা মসীহ্ অথবা নবীর দাবিদার কোনো ব্যক্তি বা জামা’তই আজ পর্যন্ত সফলতা লাভ করে নি, ব্যতিক্রম কেবল হযরত মির্যা গোলাম আহমদ কাদিয়ানী (আ.)। তিনি (আ.) যদি সত্য না হতেন তাহলে তার অবস্থাও অন্য দাবিদারদের মতই হতো।


    শহীদের পিতামাতা উভয়েই জীবিত আর আল্লাহ্ তা’লার কৃপায় তারা দুজনই আহমদী, শহীদ মরহুম পিতামাতার একমাত্র ছেলে ছিলেন আর এখনো পর্যন্ত অবিবাহিত ছিলেন। তার দুজন বোন রয়েছেন আর তারা উভয়েই বিবাহিতা, কিন্তু তারা আহমদী নন তবে তাদের তবলীগ করা হচ্ছে। আল্লাহ্ তা’লা তার পিতামাতাকে ধৈর্য ও দৃঢ় মনোবল দান করুন। যেমনটি আমি বলেছি, শহীদ পিতামাতার একমাত্র ছেলে ছিলেন, তাই তারা অনেক বেশি কষ্ট পেয়েছেন। কেবল আল্লাহ্ তা’লার অনুগ্রহেই কষ্ট সহ্যের সুযোগ পাওয়া যায়। আল্লাহ্ তা’লা শহীদের পদমর্যাদাও উন্নীত করুন। যাহোক, এই শহীদ তো আল্লাহ্ তা’লার বাণী অনুসারে স্থায়ী জীবন লাভ করেছেন। আল্লাহ্ তা’লা তার সাথে বিশেষ আচরণ করুন এবং খুব দ্রুতই এসব যালেম দুষ্কৃতকারীকে ধৃত করার উপকরণ সৃষ্টি করুন। শত্রুরা মনে করে জামা’তের সদস্যদেরকে এভাবে পরীক্ষায় ফেলে এবং বলপ্রয়োগ করে তাদের মনোবল ভেঙ্গে দিবে। কিন্তু এটি এর পুরোপুরি উল্টো বিষয়। সেখান থেকেও কিছু পত্র আমার কাছে এসেছে। অনেক যুবক লিখেছেও যে, “যদি আরো শাহাদতের প্রয়োজন পড়ে তাহলে দোয়া করুন আমরাও যেন তাতে অংশগ্রহণ করতে পারি”।


    অতএব এরূপ হীন শত্রু কী ক্ষতি করতে পারে? যাহোক, আমাদের দোয়া করা উচিত আল্লাহ্ তা’লা যেন তাদের অনিষ্ট থেকে আমাদের রক্ষা করেন এবং আমাদের প্রতি অনুগ্রহ ও দয়া করেন। এখন দোয়ার প্রতি অনেক বেশি জোর দিন।


    এরপর হুযুর (আই.) আরো চারজন প্রয়াত ব্যক্তির স্মৃতিচারণ করেন। তাদের মধ্যে প্রথমে রয়েছেন আলজেরিয়ার কামাল ভাদা সাহেব যিনি গত ২রা ফেব্রুয়ারি ইন্তেকাল করেছেন। তিনি একজন সত্যিকারের বিশ্বাসী ও আন্তরিক আহমদী ছিলেন। জামা’তের বিভিন্ন অনুষ্ঠানের জন্য তিনি তার বাড়ি উন্মুক্ত রেখেছিলেন। তিনি স্ত্রী, দুই ছেলে ও এক মেয়ে রেখে গেছেন।


    এরপর রয়েছেন, লাহোরের শহীদ মাকসুদ আহমেদ মালিক সাহেবের স্ত্রী ড. শামীম মালিক সাহেবা। স্বামীর শাহাদতের কিছুদিন পর তিনি কানাডায় চলে যান এবং সেখানেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। তিনি পিএইচডি ডিগ্রীধারী ছিলেন এবং বিভাগীয় প্রধান হিসাবে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়িয়েছেন। তিনি অ-আহমদী আত্মীয়দের কাছে আহমদীয়াতের বাণী প্রচার করতেন এবং সর্বদা প্রতিশ্রুত মসীহ্ (আ.)-এর বইপত্র অধ্যয়ন করতেন। তার জীবদ্দশায় পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তার সম্পর্কে একটি থিসিস লেখা হয়েছিল। তিনি তার ছেলে ও চার মেয়ে রেখে গেছেন।


    পরবর্তীতে রয়েছেন, জার্মানির শাহাব আহমদ আমিনি সাহেবের ছেলে ফরহাদ আহমদ। তিনি মারাত্মক হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে ২৬ বছর বয়সে মারা যান। তিনি ফ্রাঙ্কফুর্ট বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত ছিলেন এবং ওয়াক্‌ফে নও ছিলেন। তিনি খোদ্দামুল আহমদীয়ার বিভিন্ন পদে দায়িত্ব পালনের সুযোগ পেয়েছেন।


    সবশেষে রয়েছেন কানাডার চৌধুরী জাভেদ আহমেদ বিসমিল সাহেব। তিনি সম্প্রতি ইন্তেকাল করেছেন। তাহরীকে জাদীদ বিভাগে তিনি প্রায় ২৫ বছর দায়িত্ব পালন করেন। এছাড়াও তিনি নিজ জেলার আমিরসহ বিভিন্ন পদে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি স্ত্রী, চার ছেলে ও দুই মেয়ে রেখে গেছেন। তিনি অনেক মহান গুণের অধিকারী ছিলেন এবং বিশেষ করে খিলাফতকে ভালোবাসতেন। তিনি দরিদ্রদের প্রতি খুবই যত্নবান ছিলেন। তিনি অত্যন্ত অতিথিপরায়ণ ছিলেন এবং বিরোধিতা ও আক্রমণের মুখেও বীরত্ব প্রদর্শন করতেন। তার অন্তিম অসুস্থতা অনেক দীর্ঘ ছিল কিন্তু তিনি ধৈর্যের সাথে তা সহ্য করেছেন। তিনি একজন চমৎকার শিক্ষক এবং একজন দয়ালু পিতা ছিলেন।


    হুযুর (আই.) দোয়া করেন, আল্লাহ তা’লা প্রত্যেক প্রয়াত ব্যক্তির প্রতি ক্ষমা ও দয়াসুলভ আচরণ করুন, তাদের পরিবারের সদস্যদের ধৈর্যধারণের তৌফিক দান করুন এবং তাদের পদমর্যাদাকে উত্তরোত্তর উন্নীত করুন। আমীন।

  • পুর্নাঙ্গ অনুবাদ
অন্যান্য বিষয়ভিত্তিক খুতবা