بِسۡمِ اللّٰہِ الرَّحۡمٰنِ الرَّحِیۡمِِ
৩০ এপ্রিল, ২০২১
রমযানের শেষ দশক: দরূদ শরীফ ও ইস্তেগফারের গুরুত্ব ও তাৎপর্য
মসজিদ মুবারক, ইসলামাবাদ, টিলফোর্ড, লন্ডন
  • সারমর্ম
    এই জুমু’আর খুতবার সারাংশটিতে কোনো প্রকার ত্রুটি-বিচ্যুতি থাকলে তার দায়ভার আহ্‌মদীয়া বাংলা টীম গ্রহণ করছে।

    আহমদীয়া মুসলিম জামা’তের বিশ্ব-প্রধান ও পঞ্চম খলীফাতুল মসীহ্‌ হযরত মির্যা মসরূর আহমদ (আই.) গত ৩০শে এপ্রিল, ২০২১ইং ইসলামাবাদের মসজিদে মুবারকে প্রদত্ত জুমুআর খুতবায় রমযানের শেষ দশক: দরূদ শরীফ ও ইস্তেগফারের গুরুত্ব ও তাৎপর্য বর্ণনা করেন।

    তাশাহহুদ, তাআ’ব্বুয ও সূরা ফাতিহা পাঠের পর হুযূর (আই.) বলেন, আল্লাহ্ তা’লার কৃপায় বর্তমানে আমরা রমযান মাস অতিক্রম করছি আর দু’দিন পর শেষ দশকে প্রবেশ করবো। মহানবী (সা.) বলেছেন, ‘আল্লাহ্ তা’লা রমযানের শেষ দশকে (মানুষকে) জাহান্নাম থেকে মুক্তিদান করেন।’ তাই এই দিনগুলোতে আমাদের বিশেষভাবে নিজেদের ইবাদত সুন্দরভাবে পালন করা, দরূদ ও ইস্তেগফার পাঠ করা, তওবা করা, দোয়া করা, আল্লাহ্ তা’লার ইবাদতের দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন এবং সৃষ্টজীবের প্রাপ্য প্রদানের প্রতি অনেক বেশি মনোযোগ দেয়া উচিত, যেন আমরা আল্লাহ্ তা’লার সন্তুষ্টি অর্জন করে জাহান্নাম থেকে মুক্তি পেতে পারি। সাধারণ দিনগুলোতেই মহানবী (সা.)-এর ইবাদত ও কর্মপদ্ধতি কেমন ছিল- তা বর্ণনা করা আমাদের জন্য সাধ্যাতীত; আর রমযানের শেষ দশকে তাঁর (সা.) কর্মপদ্ধতি ও ইবাদতের মান কেমন হতো, সে সম্পর্কে উম্মুল মু’মিনীন হযরত আয়েশা (রা.) বলেন, ‘তিনি (সা.) তখন এমন চেষ্টা-প্রচেষ্টা করতেন যা সেই দিনগুলো ছাড়া অন্য সময় দেখা যেতো না।’ এটা তো স্পষ্ট যে রমযানের শেষ দশকে মহানবী (সা.)-এর ইবাদতের বিষয়টি আমাদের জন্য কল্পনাতীত, স্বয়ং হযরত আয়েশা (রা.)ও তা ভাষায় প্রকাশ করতে পারেন নি; কিন্তু তা সত্ত্বেও আল্লাহ্ তা’লার নির্দেশ হল- মহানবী (সা.) মু’মিনদের জন্য অনুকরণীয় আদর্শ, আমাদেরকে তার অনুসরণ করতে হবে এবং নিজেদের সাধ্যানুসারে সেই উন্নত মার্গে উপনীত হওয়ার চেষ্টা করতে হবে যা তিনি (সা.) আমাদের জন্য প্রতিষ্ঠা করে গিয়েছেন। তবেই আল্লাহ্ তা’লা আমাদের দোয়া কবুল করবেন এবং আমরা সেই পথে পরিচালিত হতে পারব, যে পথে একজন মু’মিনের ধাবমান হওয়া উচিত। তাই এ দিনগুলোতে আমাদের বিশেষভাবে দোয়ায় ব্যাপৃত থাকা উচিত। আজকাল তো আমাদের এদিকে আরও বেশি মনোযোগী হওয়া দরকার কেননা বিভিন্ন দেশে বিশেষভাবে পাকিস্তানে আহমদীদের বিরুদ্ধে ঘৃণা ও বিদ্বেষের আগুন প্রজ্জ্বলিত করার যে অপচেষ্টা করা হচ্ছে- সেটি থেকে আল্লাহ্ যেন আমাদের নিরাপদ রাখেন এবং শত্রুদের ষড়যন্ত্র যেন তাদের মুখেই ছুঁড়ে মারেন; একইসাথে করোনার যে প্রকোপ বিস্তৃত হচ্ছে, সেটি থেকেও যেন আল্লাহ্ তা’লা আমাদের নিরাপদ রাখেন। (আমীন)

    হুযূর (আই.) বলেন, আমাদের মহা-সৌভাগ্য যে, আল্লাহ্ তা’লা আমাদেরকে মহানবী (সা.)-এর কল্যাণে এবং এই যুগে তাঁর নিষ্ঠাবান দাস হযরত মসীহ্ মওউদ (আ.)-এর মাধ্যমে দোয়া করার প্রতি কেবল মনোযোগই আকর্ষণ করেন নি, বরং দোয়া কবুল হওয়ার পদ্ধতিও শিখিয়ে দিয়েছেন। আল্লাহ্ তা’লার প্রশংসা ও গুণকীর্তনের সাথে সাথে দরূদ শরীফ পাঠ করাও দোয়া কবুল হওয়ার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, নতুবা সেই দোয়া আকাশ ও পৃথিবীর মাঝখানে ঝুলে থাকে। মহানবী (সা.) স্বয়ং বলেন, ‘যে ব্যক্তি আমার প্রতি দরূদ প্রেরণ করা ছেড়ে দেয়, সে জান্নাতের পথ হারিয়ে ফেলে।’ তিনি (সা.) আরও বলেন, ‘আমার প্রতি দরূদ প্রেরণ কর, এটি তোমাদেরই পবিত্রতা ও উন্নতি অর্জনের মাধ্যম।’ তিনি (সা.) আরও বলেন, ‘যে ব্যক্তি আমার প্রতি নিষ্ঠার সাথে দরূদ প্রেরণ করবে, আল্লাহ্ তা’লা তার প্রতি দশবার দরূদ প্রেরণ করবেন, আর তাকে দশধাপ উন্নতি প্রদান করবেন ও তার নামে দশটি পুণ্য লিখবেন।’

    হুযূর (আই.) বলেন, এই হাদীসগুলো থেকে দরূদ শরীফের গুরুত্ব স্পষ্ট হয়ে যায়। আর আমরা যারা হযরত মসীহ্ মওউদ (আ.)-এর অনুসারী এবং এই দাবী করি যে, তাঁর (আ.) মাধ্যমে আমরা মহানবী (সা.)-এর অতুলনীয় মর্যাদা সম্পর্কে এমন জ্ঞান লাভ করেছি যা অন্যদের পক্ষে সম্ভব নয়- তাদের জন্য আবশ্যক, আমরা যেন দরূদের গুরুত্ব অনুধাবন করি এবং অনেক বেশি বেশি দরূদ পাঠ করার চেষ্টা করি। আর এর উদ্দেশ্য যেন কেবল দোয়া কবুল করানো না হয়, বরং দরূদের মাধ্যমে যেন আমাদের জীবনে স্থায়ী পবিত্রতা ও আল্লাহ্ তা’লার নৈকট্য অর্জিত হয়। আর আমাদের এই দাবী যে, আমরা মহানবী (সা.)-এর খাঁটি ও নিষ্ঠাবান প্রেমিক হযরত মসীহ্ মওউদ (আ.)-কে মান্য করেছি- এটি যেন বুলিসর্বস্ব না হয়; বরং আমাদের প্রতিটি কাজ যেন আমাদের দাবীর সত্যায়ন করে।

    হযরত মসীহ্ মওউদ (আ.)-এর প্রতি এলহাম হয়েছিল: ‘সাল্লে আলা মুহাম্মাদিন ওয়া আলে মুহাম্মাদিন- সৈয়্যদে উলদে আদম ওয়া খাতামান্নাবীয়্যিন’ অর্থাৎ ‘দরূদ প্রেরণ কর মুহাম্মদ (সা.) ও তাঁর বংশধরদের প্রতি, যিনি আদম-সন্তানদের নেতা ও খাতামুল আম্বিয়া।’ এই এলহামের তাৎপর্য ব্যাখ্যা করতে গিয়ে তিনি (আ.) বলেন, এটি ইঙ্গিত করছে যে, যাবতীয় মর্যাদা, শ্রেষ্ঠত্ব ও ঐশী পুরস্কাররাজি মহানবী (সা.)-এর মাধ্যমেই লাভ হয়। আল্লাহ্ তা’লার দরবারে তাঁর (সা.) কতটা সম্মান ও নৈকট্য রয়েছে যে, তাঁর (সা.) প্রেমিক আল্লাহ্ তা’লার প্রেমাস্পদে পরিণত হয়; তাঁর সেবক সারা পৃথিবীর সেবাধন্যে পরিণত হয়। আজ পৃথিবীতে হযরত মির্যা গোলাম আহমদী কাদিয়ানী (আ.) যে মসীহ্ মওউদ ও ইমাম মাহদী হওয়ার মর্যাদা লাভ করেছেন- তা কেবল মহানবী (সা.)-এর দাসত্ব ও তাঁকে ভালোবাসার কল্যাণেই লাভ করেছেন; তিনি (আ.) মহানবী (সা.)-এর প্রতি গভীর ভালোবাসার কারণেই আল্লাহ্ তা’লার কাছ থেকে উম্মতী নবী হিসেবে মহানবী (সা.)-এর উম্মতকে পুনরুজ্জীবিত করার ও মহানবী (সা.)-এর মিশনকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার দায়িত্ব লাভ করেছেন। মসীহ্ মওউদের দায়িত্ব লাভের পূর্বে তিনি (আ.) একরাতে মহানবী (সা.)-এর প্রতি গভীর ভালোবাসা নিয়ে অজস্রবার দরূদ পাঠ করেন। সেইরাতে তিনি স্বপ্নে দেখেন, স্বচ্ছ-সুমিষ্ট পানির মশকের মত ফিরিশ্তারা মশকের পর মশক ঐশী জ্যোতি তাঁর বাড়িতে নিয়ে আসছেন। একজন ফিরিশ্তা তাঁকে বলেন, ‘এটি সেই কল্যাণধারা, যা তুমি মুহাম্মদ (সা.)-এর প্রতি প্রেরণ করেছ।’ আরেকবার তাঁর (আ.) প্রতি এলহাম হয় যার সারমর্ম হল, ঊর্ধ্বাকাশের অধিবাসীরা বিতর্কে লিপ্ত; কারণ ঐশী অভিপ্রায় ধর্মকে পুনরুজ্জীবিত করতে মনস্থ করেছে, কিন্তু এই দায়িত্ব কাকে দেয়া হচ্ছে তা তখনও ঊর্ধ্বকাশে প্রকাশ করা হয় নি। তিনি (আ.) তখন স্বপ্নে দেখেন, ফিরিশ্তারা সেই ব্যক্তিকে খুঁজে বেড়াচ্ছেন; তখন একজন তাঁর সামনে এসে বলেন, ‘হাযা রাজুলুন ইয়ুহিব্বু রসূলাল্লাহ্’, ‘ইনি সেই ব্যক্তি যিনি মহানবী (সা.)-কে ভালোবাসেন।’ অর্থাৎ এই দায়িত্ব লাভের প্রধান শর্ত হল রসূলপ্রেম, যা তাঁর মাঝেই প্রকৃষ্টরূপে বিদ্যমান। কাজেই, আমরা যারা সেই মসীহ্ ও মাহদীর অনুসারী, আমাদের জন্য কি এটি অত্যাবশ্যক দায়িত্ব নয় যে, আমরাও মহানবী (সা.)-এর প্রতি অধিকহারে দরূদ প্রেরণ করে সেই মিশনকে এগিয়ে নিয়ে যাই এবং জগদ্বাসীকে বুঝাই- যে ব্যক্তির প্রতি তারা রসূল-অবমাননার মিথ্যা অপবাদ দিচ্ছে, তিনি-ই সবচেয়ে বড় রসূল-প্রেমিক? পৃথিবীকে জানাতে হবে, আমরাই হযরত মসীহ্ মওউদ (আ.)-এর কাছ থেকে দরূদের প্রকৃত তাৎপর্য শিখে মহানবী (সা.)-এর প্রতি দরূদ প্রেরণকারী; আমরাই তারা, যারা রমযানে কেবল নিজেদের ব্যক্তিস্বার্থে দোয়া করি না; বরং মুহাম্মদ (সা.)-এর মর্যাদা যেন গোটা বিশ্বে প্রতিষ্ঠিত হয়, পুরো মানবজাতি যেন মুহাম্মদ (সা.)-এর পতাকাতলে সমবেত হয়- সেজন্য বেদনার্ত হৃদয়ে বিচলিত হয়ে দোয়া করি। হুযূর (আই.) বলেন, এ এক গুরুদায়িত্ব যা আমাদের স্কন্ধে অর্পণ করা হয়েছে; তাই আমাদেরকে ভেবে দেখতে হবে, আমরা এই দায়িত্ব কতটা নিষ্ঠা ও আন্তরিকতার সাথে পালন করছি। আমাদেরকে ব্যক্তিগতভাবেও এবং সমষ্টিগতভাবেও মহানবী (সা.)-এর প্রতি অজস্রধারায় দরূদ প্রেরণ করে যেতে হবে; তাহলে পরে আমরা দেখতে পাব, আল্লাহ্ তা’লা কীভাবে শত্রুদের ষড়যন্ত্র ও আক্রমণ ধ্বংস করে দেন। সেইসাথে আমরা দোয়া কবুল হওয়ার নিদর্শনও অবলোকন করবো, কেননা রসূল (সা.)-এর হাদীস অনুসারে আল্লাহ্ তা’লার গুণকীর্তন ও মহানবী (সা.)-এর প্রতি দরূদ প্রেরণের মাধ্যমে দোয়া করা হলে তা আমাদের সকল প্রয়োজন পূরণেরও মাধ্যম হয়। কিন্তু শর্ত হল, নিষ্ঠাপূর্ণ হৃদয় দিয়ে যেন দরূদ পাঠ করা হয়, মহানবী (সা.)-এর মোকাম ও মর্যাদা উন্নত হওয়ার জন্য এক ব্যাকুলতা নিয়ে আন্তরিকভাবে দরূদ পাঠ করা হয়। আর এটি তখনই সম্ভব হবে, যখন আমরা বুঝব, অনুধাবন করব যে আমরা কী দোয়া করছি, আল্লাহ্ তা’লার কাছে কী চাইছি; নতুবা মন্ত্রপাঠের মত দরূদ পড়া অর্থহীন, আর তা হৃদয়ে সেই ব্যাকুলতা ও আন্তরিকতাও সৃষ্টি করে না।

    মহানবী (সা.)-এর প্রতি দরূদ পাঠে আমাদের কী উপকার হয়- সে সম্পর্কে হযরত মুসলেহ্ মওউদ (রা.) একস্থানে বর্ণনা করেন, দরূদ শরীফে ‘আল্লাহুম্মা সাল্লে’ রয়েছে প্রথমে, ‘আল্লাহুম্মা বারেক’ রয়েছে পরে। ‘সাল্লে’ অর্থ হল ‘তুমি দোয়া কর’। দোয়াকারী দু’প্রকার হয়ে থাকে; প্রথমত তারা যাদের নিজের কিছু নেই, তারা অন্যের কাছে চায়। দ্বিতীয় হল এমন সত্ত্বা, যার নিজের কর্তৃত্ব রয়েছে, তিনি নিজেই দান করেন। এই দৃষ্টিকোণ থেকে আল্লাহ্ তা’লার দোয়া করার অর্থ হল- তিনি নিজের সৃষ্ট জীবজগৎ, বস্তুজগতসহ সবকিছুকে নির্দেশ দেন- আমার বান্দাকে সহযোগিতা কর। অতএব ‘আল্লাহুম্মা সাল্লে’র অর্থ দাঁড়ায়- তুমি পৃথিবী ও আকাশের যাবতীয় পুণ্য ও মঙ্গল তোমার রসূলকে দান কর, তাঁকে সম্মান ও মাহাত্ম্যে ভূষিত কর। আর ‘আল্লাহুম্মা বারেক’ এর অর্থ হল- হে আল্লাহ্, তুমি মহানবী (সা.)-এর জন্য তোমার কৃপা, কল্যাণ ও পুরস্কাররাজি এত বৃদ্ধি কর, যেন সমগ্র জগতের সকল কল্যাণ তাঁর জন্য জড়ো হয়। যখন আমরা এভাবে তাঁর (সা.) জন্য দোয়া করব, তখন তাঁর উম্মত হিসেবে আমরাও মহানবী (সা.)-এর দোয়া লাভ করব, আর আল্লাহ্ তা’লা তাঁকে যে কল্যাণরাজি দান করেছেন, আমরাও তার ভাগ পাব। অন্য কথায়, যে বীজ আমরা বপন করব, তার ফল থেকে আমরাও উপকৃত হব। কিন্তু এক্ষেত্রে শর্ত হল, এই দরূদ পরম নিষ্ঠার সাথে প্রেরণ করতে হবে, মহানবী (সা.)-এর আনীত শিক্ষা অনুসারে কাজ করতে হবে, আল্লাহ্‌র প্রাপ্য ও তাঁর সৃষ্টজীবের প্রাপ্য প্রদানের প্রতি দৃষ্টি থাকতে হবে। আল্লাহ্ ও তাঁর রসূলের নামে তাঁর বান্দাদের ওপর অত্যাচার করা চলবে না, যেমনটি পাকিস্তানসহ বিভিন্ন মুসলিম দেশে দেখা যায়; দেশের আইনের বারোটা বাজিয়ে, জনগণের জন্য বিড়ম্বনা সৃষ্টি করে, রাস্তা দখল করে রসূলপ্রেমের নামে মানুষের ভোগান্তি সৃষ্টি করলে হবে না। এগুলো করার অনুমতি কক্ষনও আল্লাহ্ বা তাঁর রসূল (সা.) দেন নি, এটি তো আসলে ইসলামকে দুর্নাম করার এক হীন অপচেষ্টা।

    দরূদ শরীফের গুরুত্ব এই কথা থেকেও অনুধাবন করা যায় যে, আল্লাহ্ তা’লা পবিত্র কুরআনে মু’মিনদেরকে দরূদ পাঠের নির্দেশ দিয়েছেন এবং বলেছেন:

    **إِنَّ اللَّهَ وَمَلَائِكَتَهُ يُصَلُّونَ عَلَى النَّبِيِّ يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آَمَنُوا صَلُّوا عَلَيْهِ وَسَلِّمُوا تَسْلِيمًا**

    অর্থাৎ ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ্ এবং তাঁর ফিরিশ্তারাও এই নবীর প্রতি দরূদ প্রেরণ করেন; হে মু’মিনগণ, তোমরাও তাঁর প্রতি দরূদ প্রেরণ কর এবং তাঁর জন্য পরিপূর্ণ শান্তি কামনা কর।’ (সূরা আল্ আহযাব: ৫৭)

    যেখানে স্বয়ং আল্লাহ্ ও তাঁর ফিরিশ্তারাও দরূদ প্রেরণ করেন, তাহলে আমাদের জন্য তা কতটা গুরুত্বপূর্ণ! আর এতে ইঙ্গিত রয়েছে, মহানবী (সা.)-এর প্রতি দরূদ প্রেরণের ফলে আমরাও আল্লাহ্ তা’লার কৃপারাজির উত্তরাধিকারী হতে পারব। কারণ ফিরিশ্তারা যখন মহানবী (সা.)-এর প্রতি দরূদ প্রেরণ করবে, তখন তা মহানবী (সা.)-এর প্রকৃত অনুসারীরাও লাভ করবে। এই আয়াতের ব্যাখ্যা করতে গিয়ে হযরত মসীহ্ মওউদ (আ.) বলেন, মহানবী (সা.)-এর সত্যপরায়ণতা ও বিশ্বস্ততার কারণে আল্লাহ্ তা’লা নির্দেশ দিয়েছেন যে, এখন থেকে ভবিষ্যতে মানুষ তাঁর (সা.) প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রদর্শনার্থে দরূদ পাঠ করবে। হুযূর (আই.) দোয়া করেন, আল্লাহ্ তা’লা আমাদেরকে এই রমযান মাসেও এবং ভবিষ্যতেও সর্বদা দরূদের গুরুত্ব অনুধাবন করে দরূদ পাঠের সৌভাগ্য দান করুন। আল্লাহুম্মা সাল্লে আলা মুহাম্মাদিন ওয়া আলা আলে মুহাম্মাদিন কামা সাল্লাইতা আলা ইব্রাহীমা ওয়া আলা আলে ইব্রাহীমা ইন্নাকা হামীদুম্ মাজীদ। আল্লাহুম্মা বারেক আলা মুহাম্মাদিন ওয়া আলা আলে মুহাম্মাদিন কামা বারাকতা আলা ইব্রাহীমা ওয়া আলা আলে ইব্রাহীমা ইন্নাকা হামীদুম্ মাজীদ।

    হুযূর (আই.) দ্বিতীয় যে বিষয়টির প্রতি মনোযোগ আকর্ষণ করেন তা হল, ইস্তেগফার তথা এই দোয়া করা- আস্তাগফিরুল্লাহা রাব্বি মিন কুল্লি যাম্বিওঁ ওয়া আতূবু ইলাইহি অর্থাৎ ‘আমি আমার যাবতীয় পাপ থেকে আমার প্রভু আল্লাহ্‌র কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করছি এবং তাঁরই সমীপে প্রত্যাবর্তন করছি’। এটি এমন এক দোয়া যা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। হযরত মসীহ্ মওউদ (আ.) বলেন, ইস্তেগফারের প্রকৃত অর্থ হল, আল্লাহ্‌র কাছে এই প্রার্থনা করা যে, তার দ্বারা যেন মানবীয় ত্রুটি বিচ্যুতি প্রকাশ না পায়, আর আল্লাহ্ তা’লা যেন তার প্রকৃতিকে সামর্থ্য দেন এবং তাকে নিজ সাহায্যের গণ্ডিভুক্ত করে নেন, আল্লাহ্ ইস্তেগফারকারীকে নিজের শক্তি থেকে শক্তি দান করেন, তাঁর জ্ঞান থেকে জ্ঞান দান করেন এবং তাকে প্রকৃতিগত দুর্বলতা থেকে রক্ষা করেন। বৃহত্তর অর্থে বান্দার দ্বারা কৃত পাপের ক্ষমা প্রার্থনাও এর অন্তর্ভুক্ত, তবে তা এর প্রকৃত অর্থ নয়। যেহেতু খোদার একটি নাম হল, কাইয়্যুম অর্থাৎ তিনি স্বয়ং চিরস্থায়ী এবং অপর সকলকে স্থিতীদাতা, তাই মানুষের জন্য আবশ্যক সে যেন সেই কাইয়্যুম খোদার কাছে নিজের স্থিতাবস্থার জন্য সাহায্য প্রার্থনা করে। আয়াতুল কুরসীতেও এদিকেই ইঙ্গিত করা হয়েছে। কাইয়্যুম খোদার কাছ থেকে মানুষকে সদা-সর্বদা সাহায্য নিতে থাকতে হয়। আর ইস্তেগফার হল, আল্লাহ্ তা’লার কাইয়্যুম বৈশিষ্ট্যেল দ্বারা উপকৃত হওয়ার দোয়া। শয়তানের আক্রমণ একটি নিরন্তর বিষয়, তাত্থেকে বাঁচার জন্য ইস্তেগফার একান্ত আবশ্যক। এটি ভুল যে, পাপ করে ফেললে পরে ইস্তেগফার করতে হবে; পাপ সংঘটিত হবার পরও ইস্তেগফার করতে হবে, কিন্তু সেটি ছাড়াও সবসময়ই ইস্তেগফার করতে হবে। শয়তান তো সর্বদা আমাদের পথে ওঁৎ পেতে বসে আছে, তাই তার আক্রমণ থেকে বাঁচার উপায়ই হল ইস্তেগফার করা। ইস্তেগফার মানুষকে পূর্বকৃত পাপ থেকে আত্মরক্ষার শক্তি দান করে; আর ক্রমাগত ইস্তেগফারকারী অবশেষে আল্লাহ্র কৃপায় পাপ থেকে মুক্তিলাভ করতে সক্ষম হয়। আল্লাহ্ তা’লার কৃপা ও ক্ষমা কত বিশাল, হাদীসে বর্ণিত সে সংক্রান্ত একটি ঘটনাও হুযূর উদ্ধৃত করেন যে, এক ব্যক্তি কিভাবে একশ’ খুন করার পরও অনুতাপের কারণে অবশেষে ক্ষমা লাভ করেছিল। হুযূর (আই.) বলেন, আজকাল অনেক শিশু ও যুবকরা এই প্রশ্ন করে বসে, আল্লাহ্ তা’লা কতটা পর্যন্ত পাপ ক্ষমা করেন; এই ঘটনায় তার উত্তর রয়েছে। বস্তুত তাঁর ক্ষমার কোন সীমা নেই, তিনি তওবা কবুল করেন, তওবা কবুল করাই তাঁর প্রকৃতির নিয়ম। আল্লাহ্ কোন কোন পাপীকে ক্ষমা করবেন বা কাকে করবেন না- এমন চিন্তা করাও পাপ। একথা ঠিক, মানুষ পাপ করতে করতে যখন অন্তিম মুহূর্তে পৌঁছে যায়, অর্থাৎ তার অন্তিম সময় এসে উপস্থিত হয়, তখন তার তওবা কবুল হয় না। প্রকৃত তওবা বা অনুতাপসহ প্রত্যাবর্তন করলে হাদীসের ভাষ্য অনুসারে আল্লাহ্ এতটা আনন্দিত হন, যেভাবে বিরাণ মরুভূমিতে নিজের বাহন ও সর্বস্ব হারানো ব্যক্তি তার উট খুঁজে পেলে আনন্দিত হয়। তাই আমাদের দায়িত্ব হল, আমরা যেন নিজেদের পাপ ক্ষমা করানোর জন্য আল্লাহ্ ত’লার প্রতি অগ্রসর হই।

    হুযূর (আই.) বলেন, রমযান মাস যেহেতু দোয়া কবুল হওয়ার মাস, আর এর শেষ দশক যেহেতু জাহান্নাম থেকে মুক্তির মাধ্যম, তাই এই দিনগুলোতে আমাদের অনেক বেশি তওবা ও ইস্তেগফার করা উচিত। পাপ থেকে ক্ষমা ও পুণ্য সাধনের সামর্থ্য আল্লাহ্ তা’লার কাছ থেকেই লাভ করা সম্ভব। যদি আমরা আল্লাহ্ তা’লার সাথে সম্পর্ক স্থাপন করে ফেলতে পারি, আমাদের দরূদ ও ইস্তেগফার যদি আল্লাহ্ তা’লার সন্তুষ্টি অর্জন করতে সক্ষম হও, তাহলে আমাদের ইহকাল ও পরকাল দু’টোই সুসজ্জিত হয়ে যাবে; শত্রু হাজার চেষ্টা করলেও আমাদের কোন ক্ষতি করতে পারবে না। কিন্তু আল্লাহ্ তা’লা যদি আমাদের প্রতি সন্তুষ্ট না হন, তাহলে পৃথিবীর কোন বুদ্ধিই আমাদের কাজে আসবে না, কোন চেষ্টাই আমাদের উপকারে আসবে না। তাই আমাদের আল্লাহ্ তা’লার সাথে সম্পর্ক নিবিড় করার চেষ্টা করতে হবে। রমযানের দোয়ায় বিরুদ্ধবাদীদের দুষ্কৃতি থেকে রক্ষা পাবার জন্যও অনেক বেশি দোয়া করুন; কিছু কিছু স্থানে আহমদীরা অনেক বিপদে নিপতিত, আল্লাহ্ তা’লা তাদের জন্য স্বাচ্ছন্দ্য সৃষ্টি করুন, বিরুদ্ধবাদীদের অনিষ্ট থেকে তাদের নিরাপদ রাখুন। (আমীন)। হুযূর (আই.) পাকিস্তানের আহমদীদের বিশেষভাবে বলেন, তারা যেন নিজেদের জন্য এবং জামাতের জন্যও অনেক বেশি করে দোয়া করেন; এছাড়া করোনার প্রাদুর্ভাব থেকে নিরাপদ থাকার জন্যও হুযূর (আই.) দোয়ার তাহরীক করেন, আল্লাহ্ তা’লা যেন এই বিপদ থেকেও পৃথিবীবাসীকে অচিরেই মুক্তি দান করেন, আর আমাদের নিরাপদ রাখেন। আল্লাহ্ তা’লা আমাদের প্রকৃত অর্থে দরূদ পাঠকারী ও ইস্তেগফারকারী বানান। (আমীন)

  • পুর্নাঙ্গ অনুবাদ
বিষয়ঃ
শেয়ার করুনঃ
অন্যান্য বিষয়ভিত্তিক খুতবা