بِسۡمِ اللّٰہِ الرَّحۡمٰنِ الرَّحِیۡمِِ
১০ নভেম্বর, ২০১৭
সততা ও ন্যায়বিচার
মসজিদ বাইতুল ফুতুহ্, লন্ডন
  • সারমর্ম
    এই জুমু’আর খুতবার সারাংশটিতে কোনো প্রকার ত্রুটি-বিচ্যুতি থাকলে তার দায়ভার আহ্‌মদীয়া বাংলা টীম গ্রহণ করছে।

    নিখিল বিশ্ব আহমদীয়া মুসলিম জামাতের বর্তমান ইমাম হযরত মির্যা মসরূর আহমদ খলীফাতুল মসীহ্ আল্ খামেস (আই.) গত ১০ই নভেম্বর, ২০১৭ইং রোজ শুক্রবার লন্ডনের বায়তুল ফুতুহ মসজিদ থেকে “সততা ও ন্যায়বিচার”- সম্পর্কে জুমুআর খুতবা প্রদান করেন।

    তাশাহুদ, তাঊয, তাসমিয়া এবং সূরা ফাতিহা পাঠের পর, সূরা নিসার ১৩৬নং, সূরা মায়েদার ৯নং এবং সূরা আরাফের ১৮২নং আয়াত তেলাওয়াত করেন।

    হুযূর আনোয়ার (আই.) বলেন, আল্লাহ্ তা’লা ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার জন্য যেভাবে এবং যে পর্যায়ের নির্দেশ মুসলমানদেরকে দিয়েছেন, অন্য কোন ধর্মগ্রন্থে সেরকম পাওয়া যায় না। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় হল বর্তমানে সর্বস্তরে অধিকাংশ মুসলমান, যাদের মধ্যে মুসলমান নেতৃবৃন্দ এবং আলেমরাও অন্তর্ভুক্ত, ন্যায়বিচারের দাবী পূরণ করে না। একইভাবে ঘরোয়া পর্যায়েও সাধারণ মুসলমানদের মাঝে নিত্য-নৈমিত্তিক বিষয়াদিতে ন্যায়বিচারের সেই মান দেখা যায় না যার নির্দেশ আল্লাহ্ দিয়েছেন বা যা একজন মুমিনের কাছ থেকে আশা করা যায়। ঘরোয়া বিষয়াদি নিয়ে নিজের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য বা অন্যের অধিকার খর্ব করার জন্যও মামলা ইত্যাদিতে মিথ্যার আশ্রয় নেয়া হয়, আবার কখনো বিচারকও ব্যক্তিগত স্বার্থে অন্যায় রায় প্রদান করেন। মোটকথা ব্যবস্থাপনার মাঝেও অন্যায় ঢুকে গেছে, আর এর ফলে সমাজেও অন্যায় ছড়িয়ে পড়েছে। জাতীয় পর্যায়েও শাসকগণ ন্যায়ের দাবী পূর্ণ করে না, এক দেশ আরেক দেশের সাথে ন্যায় আচরণ করে না, আলেমরা ধর্মকে ব্যক্তিস্বার্থ আদায়ের মাধ্যম বানিয়ে নিয়েছে। এসব কিছু সত্ত্বেও মুসলমানরা দাবী করে- আমরাই শ্রেষ্ঠ জাতি আর ইসলামই পৃথিবীর যাবতীয় সমস্যার সর্বোত্তম সমাধান প্রদান করে। হুযুর (আই.) বলেন, নিঃসন্দেহে মুসলমানরাই শ্রেষ্ঠ জাতি, যদি তারা আল্লাহ্‌র নির্দেশ মান্য করে ও কুরআনের শিক্ষামালাকে অনুসরণ করে; ইসলামই পৃথিবীর সমস্যাবলীর সমাধান করবে, যদি ইসলামের শিক্ষানুসারে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা হয়।

    হুযুর (আই.) সূরা নিসার ১৩৬নং আয়াতের অনুবাদ তুলে ধরেন-“হে যারা ঈমান এনেছ! তোমরা আল্লাহ্‌র সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে সাক্ষ্যদাতা হিসেবে দৃঢ়ভাবে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠাকারী হও, এমনকি তা তোমাদের নিজেদের বা পিতামাতার এবং নিকটাত্মীয়দের বিরুদ্ধে গেলেও; সে ধনী হোক বা দরিদ্র হোক, আল্লাহ্ই উভয়ের সর্বোত্তম অভিভাবক। অতএব তোমরা কুপ্রবৃত্তির অনুসরণ করো না যাতে তোমরা ন্যায়বিচার করতে সক্ষম হও। আর তোমরা যদি পেঁচিয়ে কথা বল অথবা সত্যকে এড়িয়ে যাও, তাহলে স্মরণ রেখো, তোমরা যা কর সে সম্বন্ধে আল্লাহ্ নিশ্চয় পুরোপুরি অবহিত।” হুযুর (আই.) বলেন, এটি হল ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার মানদন্ড- তা ঘরোয়া বিষয়েই হোক বা সামাজিক পর্যায়ে হোক- অবস্থা যা-ই হোক, সর্বদা ন্যায়ের উপর প্রতিষ্ঠিত থাকতে হবে। মুমিনদের জন্য নির্দেশ হল তাদের সাক্ষ্য হতে হবে আল্লাহ্‌র খাতিরে এবং তাঁর সন্তুষ্টির জন্য, আর এটি তখন সম্ভব যখন আল্লাহ্‌র সত্ত্বায় দৃঢ় ও পরিপূর্ণ বিশ্বাস থাকবে। আর সেই বিশ্বাস যে রয়েছে তা তখন বোঝা যাবে যখন দেখা যাবে মানুষ তার নিজের বা স্ত্রী-সন্তানদের বা মা-বাবা কিংবা নিকটাত্মীয়দের বিরুদ্ধেও সাক্ষ্য দিতে প্রস্তুত থাকবে।

    হুযুর (আই.) বলেন, আজকাল অধিকাংশ সমস্যার কারণ এটিই যে ন্যায়নিষ্ঠা ও সততা সেই মানে উন্নীত নয় যা আল্লাহ্ চেয়েছেন। দুঃখের বিষয় হল আজকাল আমাদের মাঝেও কতক ব্যক্তি পার্থিবতার টানে ও প্রভাবে এমন কথা বলে বা এমন সাক্ষ্য দিয়ে বসে, যা প্রকৃত ঘটনা থেকে ভিন্ন। দাম্পত্যকলহ সংক্রান্ত বিষয়ে বা আর্থিক লেন-দেন সংক্রান্ত বিষয়ে প্রকৃত ঘটনা আড়াল করা হয়। বাহ্যত ধার্মিক ও জামাতের সেবায় অগ্রসর কোন ব্যক্তিও এমন কাজ করে বসেন যা দেখে অন্যরা আশ্চর্য হয়ে যায়। হুযুর (আই.) বলেন, সর্বদা স্মরণ রাখা উচিত- আল্লাহ্ তা’লা বলেছেন, তোমরা যা গোপন কর তা-ও আল্লাহ্ খুব ভালভাবে জানেন। চালাকি দিয়ে এই পৃথিবীতে যদি পার পেয়েও যাও, পরকালে অবশ্যই ধরা পড়বে। হুযুর (আই.) মসীহ্ মওউদ (আ.)-এর যৌবনের সময়কার একটি ঘটনা তুলে ধরেন, তিনি (আ.) তাঁর পিতার কোন একটি মামলায় উকিলের নির্দেশ উপেক্ষা করে আদালতে সত্য সাক্ষ্য প্রদান করেন, যা তাঁর পিতার বিরুদ্ধে যায় এবং মামলায় পরাজয় হয়। প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনা হল, তিনি যখন বাড়ি ফিরছিলেন, তখন তাঁর চেহারায় এমন আনন্দের ছাপ ছিল যা দেখে মনে হচ্ছিল যেন তিনি মামলায় জিতেছেন। এই আদর্শকে সামনে রেখে আমাদের নিজেদের অবস্থা যাচাই করতে হবে। কুরআনের এই নীতিমালা না মানলে আমাদের পারস্পরিক সম্পর্ক নষ্ট হবে। আল্লাহ্ তা’লার অপার করুণা যে তিনি আমাদেরকে যুগের ইমামকে মানার সৌভাগ্য দান করেছেন, পরস্পর ভাই-ভাই হওয়ার ব্যবস্থা করেছেন। আর আমরা তুচ্ছ জাগতিক স্বার্থের জন্য বা নিজেদের আমিত্বের কারণে, কিংবা অন্যের প্রতি হিংসা-বিদ্বেষের কারণে প্রতিশোধপরায়ণ হয়ে উঠি, আর প্রতিশোধ নিতে গিয়ে আল্লাহ্‌র ভয়ও মন থেকে হারিয়ে যায়। অথচ এমন পরিস্থিতিতে একজন মুমিনের দায়িত্ব হল বিষয়টি আল্লাহ্‌র উপর ছেড়ে দেয়া।

    হুযুর (আই.) বলেন, সমাজে ন্যায়বিচার ও সততা প্রতিষ্ঠার পর মুমিনদেরকে আল্লাহ্ তা’লা এই নির্দেশও দিয়েছেন যে ব্যক্তিগত, সামাজিক বা জাতীয় স্বার্থেরও ঊর্ধ্বে গিয়ে উন্নত মানের ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা কর, এমনকি শত্রু জাতির সাথেও এর আদর্শ প্রতিষ্ঠা কর। হুযুর (আই.) সূরা মায়েদার ৯নং আয়াতের অনুবাদ তুলে ধরেন- “হে যারা ঈমান এনেছ! তোমরা আল্লাহ্‌র উদ্দেশ্যে ন্যায়ের পক্ষে সাক্ষী হিসেবে দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত হও। আর কোন জাতির শত্রুতা যেন তোমাদেরকে কখনো অবিচার করতে প্ররোচিত না করে। তোমরা সদা ন্যায়বিচার করো, এটি তাকওয়ার সবচেয়ে নিকটবর্তী। আর তোমরা আল্লাহ্‌র তাকওয়া অবলম্বন কর। নিশ্চয় তোমরা যা কর সে সম্বন্ধে আল্লাহ্ পুরোপুরি অবহিত।” হুযুর (আই.) বলেন, কখনো কখনো ধর্মীয় বিরোধের কারণে অন্য ধর্মের লোকেরা অন্যায় করে থাকে, কিন্তু এমন পরিস্থিতিতে একজন মুমিনের বৈশিষ্ট্য এটি নয় যে অন্যদের মত সে-ও সুযোগমত প্রতিশোধ নিবে আর ন্যায়ের দাবী পূরণ করবে না। একজন প্রকৃত মুমিনের কাজ হল আল্লাহ্‌র নির্দেশকে দৃঢ়ভাবে ধারণ করা ও তাতে প্রতিষ্ঠিত হওয়া। একজন মুমিনের প্রতিটি কাজ আল্লাহ্‌র সন্তুষ্টির খাতিরে হওয়া উচিত। আজকাল পাশ্চাত্যে মুসলমানদের যে দুর্নাম করা হয় তা হল- এরা তো নিজেদের প্রতিই এরকম অন্যায় আচরণ করে, আমাদের সাথে না জানি কেমন করবে? আর বিভিন্ন মুসলিম জঙ্গীগোষ্ঠীও ভিন্ন ভিন্ন পন্থায় পশ্চিমাদের উপর আক্রমণ করে আসছে। অথচ তাদের উচিত ছিল ইসলামের অতুলনীয় ও অনুপম শিক্ষা, এর সৌন্দর্যের ব্যবহারিক রূপ নিজেদের জীবনে বাস্তবায়ন করে দেখান। অন্য মুসলমানরা যেহেতু তাদের কাজের মাধ্যমে ইসলামের দুর্নামই করে চলেছে, এমতাবস্থায় আমাদের উপর দায়িত্ব বর্তায় আমরা যেন নিজেদের ব্যবহারিক নমুনা দিয়ে ইসলামের অতুলনীয় ও অনুপম শিক্ষাকে তুলে ধরি, তবেই তা পৃথিবীর হেদায়েতের কারণ হবে। সূরা আরাফের ১৮২নং আয়াতে এই বিষয়টিই বর্ণিত হয়েছে, যার অনুবাদ হল-“আর আমাদের সৃষ্টির মাঝে এমন এক দল আছে যারা লোকদেরকে সত্যের মাধ্যমে পথনির্দেশনা দান করে এবং এরই মাধ্যমে সুবিচার করে।” হেদায়েত বা সঠিক পথের দিশা তারাই মানুষকে দিতে পারে, যারা নিজেরা সত্য ও ন্যায়ের উপর প্রতিষ্ঠিত থাকে। মানুষ নিজেই যদি ন্যায়ের উপর প্রতিষ্ঠিত না থাকে, তবে অন্যকে কিভাবে ন্যায়ের উপর প্রতিষ্ঠিত করবে? তাই আমরা যদি মসীহ্ মওউদ (আ.)-এর হাতে বয়আতের অঙ্গীকারকে পূর্ণ করতে চাই, তাঁর মিশনকে পূর্ণ করতে চাই, ইসলামের বাণীকে পৃথিবীতে ছড়িয়ে দিতে চাই, তবলীগের দায়িত্ব পালন করতে চাই-তাহলে ইসলামের শিক্ষানুসারে যাবতীয় উন্নত চরিত্র আত্মস্থ করতে হবে। যদি আমাদের সাক্ষ্য, আমাদের কর্মকান্ড ইসলামের শিক্ষামত না হয়, তাহলে আমাদের তবলীগও বৃথা। সেক্ষেত্রে অন্যরা আমাদের উল্টো বলে বসবে-আগে নিজেরা ঠিক হও, নিজেরা এসব কথা মান, পরে আমাদেরকে বলতে এসো। অতএব এটি অত্যন্ত গুরুদায়িত্ব যা প্রত্যেক আহমদীর উপর অর্পিত হয়েছে-নিজের কর্ম দ্বারা তবলীগের পথ খোলা। আর যারা আমাদের কাজ দেখে ইসলাম চিনবে, তারা ইসলামের শ্রেষ্ঠত্ব স্বীকার না করে পারবে না। হুযুর (আই.) দোয়া করেন, আল্লাহ্ করুন আমরা যেন তাঁর নির্দেশমত নিজেদের জীবন সাজাতে পারি, মসীহ্ মওউদ (আ.)-এর হাতে বয়আতের দায়িত্ব পালনকারী হই, অন্যদের জন্য হেদায়েত ও ন্যায়নিষ্ঠার আদর্শ হতে পারি। আমীন।

    খুতবার শেষদিকে হুযুর (আই.) একটি গায়েবানা জানাযার ঘোষণা করেন। মোকাররম ফযল মুহাম্মদ খান সাহেবের পুত্র মোকাররম হাসান মুহাম্মদ খান আরেফ সাহেব, যিনি সুদীর্ঘকাল নায়েব উকিলুত তবশির, রাবওয়া হিসেবে সেবা করেছেন, গত ৩ নভেম্বর ৯৭ বছর বয়সে ইন্তেকাল করেছেন। হুযুর (আই.) মরহুমের বিস্তৃত ধর্মসেবার সংক্ষিপ্ত বিবরণ দেন ও তার পদমর্যাদা বৃদ্ধির জন্য দোয়া করেন।

  • পুর্নাঙ্গ অনুবাদ
বিষয়ঃ
শেয়ার করুনঃ
অন্যান্য বিষয়ভিত্তিক খুতবা