بِسۡمِ اللّٰہِ الرَّحۡمٰنِ الرَّحِیۡمِِ
৬ মার্চ, ২০২০
শ্রেষ্ঠ মহাপুরুষ – নিষ্ঠাবান বদরী সাহাবীগণ | করোনা ভাইরাস সম্পর্কিত উপদেশ
মসজিদ মুবারক, ইসলামাবাদ, টিলফোর্ড, লন্ডন
  • সারমর্ম
    এই জুমু’আর খুতবার সারাংশটিতে কোনো প্রকার ত্রুটি-বিচ্যুতি থাকলে তার দায়ভার আহ্‌মদীয়া বাংলা টীম গ্রহণ করছে।

    আহমদীয়া মুসলিম জামা’তের বিশ্ব-প্রধান ও পঞ্চম খলীফাতুল মসীহ্‌ হযরত মির্যা মসরূর আহমদ (আই.) গত ৬ই মার্চ, ২০২০ লন্ডনের বায়তুল ফুতুহ মসজিদে প্রদত্ত জুমুআর খুতবায় পূর্বের ধারা অনুসরণে নিষ্ঠাবান বদরী সাহাবীদের বর্ণাঢ্য জীবনের স্মৃতিচারণ করেন। এ খুতবায় তিনি হযরত মুসআব বিন উমায়ের (রা.)’র জীবনের স্মৃতিচারণ করেন এবং করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের প্রেক্ষাপটে আমাদের দায়িত্ব-কর্তব্য ও করণীয় তুলে ধরেন।


    হুযূর (আই.) তাশাহহুদ, তাআ’ব্বুয ও সূরা ফাতিহা পাঠের পর বলেন, বিগত খুতবায় হযরত মুসআব বিন উমায়ের (রা.)’র স্মৃতিচারণে কিছু অংশ অবশিষ্ট রয়ে গিয়েছিল; আজ আমি তা বর্ণনা করব। হযরত মুসলেহ্ মওউদ (রা.) মদীনার মোবাল্লিগ হিসেবে হযরত মুসআব বিন উমায়ের (রা.)’র উল্লেখ করেছেন এবং তার ইসলামসেবার উল্লেখ করেছেন। মুসলেহ্ মওউদ (রা.)’র লেখা থেকে হুযূর এ সংক্রান্ত উদ্ধৃতি উপস্থাপন করেন। প্রথম উদ্ধৃতি অনুসারে আকাবার প্রথম বয়আতের পর যখন মদীনার নওমুসলিমগণ মদীনায় তবলীগ করছিলেন এবং একে একে মুসলমানদের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছিল, তখন মদীনাবাসীদের আবেদনের প্রেক্ষিতে মহানবী (সা.) মুসআব বিন উমায়ের (রা.)-কে মদীনায় তবলীগের জন্য প্রেরণ করেন এবং মক্কার বাইরে তিনি-ই ইসলামের প্রথম মোবাল্লিগ ছিলেন। অপর এক স্থানেও তিনি মুসআব বিন উমায়েরের উল্লেখ করেছেন এবং বলেছেন, আকাবার প্রথম বয়আতের সময়ই, যখন মহানবী (সা.) মদীনার নব-দীক্ষিত বারজন মুসলমানকে নকীব বা নেতা নির্বাচন করেন এবং মদীনায় ইসলাম প্রচারের জন্য তাদেরকে নির্দেশ দেন, তখন একইসাথে তাদের শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের জন্য মুসআব বিন উমায়েরকেও তাদের সাথে পাঠিয়ে দেন।


    মদীনায় হিজরতের পর মহানবী (সা.) হযরত মুসআব বিন উমায়ের ও হযরত আবু আইয়ুব আনসারীর মাঝে ভ্রাতৃত্ব বন্ধন রচনা করেন। হযরত মুসআব বদর ও উহুদের যুদ্ধে অংশগ্রহণের সৌভাগ্য লাভ করেন। বদর ও উহুদের যুদ্ধে মুহাজিরদের পতাকা হযরত মুসআবের হাতেই ছিল। বদরের যুদ্ধের সময় মুহাজিরদের বড় একটি পতাকা মহানবী (সা.) তার হাতে তুলে দিয়েছিলেন। উহুদের যুদ্ধের সময় কুরাইশদের পতাকা তালহা নামক এক ব্যক্তির হাতে ছিল। মক্কা নগরীর আধুনিক ব্যবস্থাপনার স্থপতি ছিল কুছাই বিন ক্বিলাব; তার প্রতিষ্ঠিত ব্যবস্থাপনায় যে বংশের ওপর পতাকাবহনের দায়িত্ব অর্পিত হয়েছিল, তালহা সেই পরিবারের সদস্য ছিল। মহানবী (সা.) যখন এটি জানতে পারেন, তখন তিনি বলেন, ‘আমরা জাতির প্রতি বিশ্বস্ততা প্রদর্শনের অধিক দাবিদার।’ একথা বলে তিনি মুহাজিরদের পতাকা হযরত আলীর কাছ থেকে নিয়ে হযরত মুসআবের হাতে তুলে দেন, যিনি সেই একই বংশের লোক ছিলেন। হযরত মুসআব উহুদের যুদ্ধে শাহাদত বরণ করেন। উহুদের যুদ্ধের দিন তিনি মহানবী (সা.)-এর সামনে দাঁড়িয়ে যুদ্ধ করছিলেন, এক পর্যায়ে ইবনে কামিয়াহ্ তাকে শহীদ করে। সে প্রথমে হযরত মুসআবের ডানহাতে তরবারি দিয়ে আঘাত করে, যে হাত দিয়ে তিনি পতাকা ধরে রেখেছিলেন। ইবনে কামিয়ার আক্রমণে তার ডানহাত কেটে গেলে তিনি পতাকা বা’হাতে ধারণ করেন, তখন ইবনে কামিয়াহ্ তরবারির আরেক আঘাতে তার বা’হাতও কেটে ফেলে। হযরত মুসআব তৎক্ষণাৎ পতাকা কোনক্রমে বুকে জাপটে ধরেন। ইবনে কামিয়াহ্ তখন বর্শা দিয়ে তার বুকে আঘাত করে এবং তিনি সেখানেই শাহাদত বরণ করেন। বনু আব্দুদ দ্বারের দু’জন মুসলমান সুয়াইবাত বিন সা’দ বিন হারমালা ও আবু রূম বিন উমায়ের দ্রুত তার কাছে ছুটে আসেন এবং আবু রূম পতাকা ভূপাতিত হওয়ার আগেই নিজের হাতে তুলে নেন। শাহাদতের সময় হযরত মুসআবের বয়স ৪০ বছরের কিছু বেশি ছিল। হযরত মুসআবের চেহারা মহানবী (সা.)-এর সাথে কিছুটা সাদৃশ্য রাখত। ইবনে কামিয়াহ্ তাকে হত্যা করে উল্লসিত হয়ে চিৎকার করে, ‘আমি মুহাম্মদকে (সা.) হত্যা করেছি!’ এটিও হতে পারে যে, সে জেনে-বুঝেই কোন দুরভিসন্ধি নিয়ে এই ঘোষণা দিয়েছিল। সে যা-ই হোক, তার এই ঘোষণার ফলে কুরাইশরা, যারা মহানবী (সা.)-কে ঘিরে থাকা সাহাবীদের ওপর উপর্যপুরি আক্রমণ করছিল, তাদের আক্রমণ বন্ধ হয়। যুদ্ধের পর যখন মহানবী (সা.) তার লাশের কাছে পৌঁছেন তখন সূরা আহযাবের ২৪নং আয়াত পড়েন যার বঙ্গানুবাদ হল: ‘মুমিনদের মাঝে এমন ব্যক্তিরা রয়েছে, যারা তাদের সেই অঙ্গীকার সত্য প্রমাণ করে দেখিয়েছে যা তারা আল্লাহ্‌র সাথে করেছিল। তাদের মধ্যে কতক এমনও রয়েছে যারা (শাহাদতের মাধ্যমে) নিজেদের সংকল্প পূর্ণ করেছে, আর কতক এমনও রয়েছে যারা (শাহাদতের) অপেক্ষায় রয়েছে; আর তারা (নিজেদের সংকল্প থেকে) বিন্দুমাত্রও বিচ্যুত হয় নি।’ এরপর মহানবী (সা.) বলেন, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ্‌র রসূল সাক্ষ্য দিচ্ছেন যে, কিয়ামতের দিন তোমরা আল্লাহ্‌র কাছে শহীদ গণ্য হবে।’ এরপর তিনি (সা.) সাহাবীদের ডেকে বলেন, ‘তাকে দেখে নাও এবং তার প্রতি সালাম প্রেরণ কর। সেই সত্তার কসম যার হাতে আমার প্রাণ! কিয়ামত পর্যন্ত যে তার প্রতি সালাম প্রেরণ করবে, সে তার সালামের উত্তর দিবে।’ হযরত মুসআবের জ্ঞাতিভাই সুয়াইবাত বিন সা’দ, আবু রূম বিন উমায়ের ও আমের বিন রবীআ তার লাশ কবরে শায়িত করেন। শাহাদতের সময় তার এতটুকুও কাপড় ছিল না, যা দিয়ে তার পূর্ণ কাফনের ব্যবস্থা করা যায়। সহীহ বুখারীতে বর্ণিত হয়েছে, একবার আব্দুর রহমান বিন অওফ রোযা ছিলেন, ইফতারির সময় বিভিন্ন রকম খাবার উপস্থাপন করা হলে তিনি বলেন, ‘মুসআব বিন উমায়ের শহীদ হন, আর তিনি আমার চেয়ে উত্তম ছিলেন, অথচ মাত্র একটি চাদর তার কাফন হয়েছিল; এটি দিয়ে তার মাথা ঢাকলে পা উন্মুক্ত হয়ে যেতো আর পা ঢাকলে মাথা উন্মুক্ত হয়ে যেতো।’ হযরত মুসআবের স্মৃতিতে তিনি অশ্রুসিক্ত হন এবং আহার ছেড়ে উঠে যান। হাদীসে বর্ণিত হয়েছে যে, মহানবী (সা.) বলেন, ‘প্রত্যেক নবীকে সাতজন সম্ভ্রান্ত সঙ্গী দেয়া হয়েছে, আমাকে দেয়া হয়েছে ১৪ জন,’ এই তালিকায় তিনি (সা.) মুসআব বিন উমায়েরকেও অন্তর্ভুক্ত করেছেন।


    মহানবী (সা.) উহুদের যুদ্ধ শেষে মদীনায় ফিরলে মুসআবের স্ত্রী হামনা বিনতে জাহশের সাথে দেখা হয়। তাকে একে একে তার মামা হামযা (রা.), ভাই আব্দুল্লাহ্ বিন জাহশ (রা.) ও স্বামী মুসআব বিন উমায়েরের শাহাদাতের সংবাদ দেয়া হয়। প্রথমোক্ত দু’জনের খবর শুনে তো তিনি ইন্না লিল্লাহ্ পড়েন ও তাদের মাগফিরাতের জন্য দোয়া করেন, কিন্তু স্বামীর মৃত্যুসংবাদে তিনি বিচলিত হয়ে পড়েন। মহানবী (সা.) তখন বলেন, স্বামীর প্রতি নারীদের এক বিশেষ টান থেকে থাকে, এজন্যই সে স্বামীর মৃত্যুসংবাদে বিচলিত হয়ে পড়েছে।


    হযরত মুসআব বিন উমায়েরের স্মৃতিচারণ শেষে হুযূর সম্প্রতি বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়া করোনা ভাইরাসের মহামারী এবং এর চিকিৎসা ও প্রতিরোধের জন্য প্রয়োজনীয় কিছু দিকনির্দেশনা প্রদান করেন। হুযূর এই মহামারীর সংক্রমণের শুরুর দিকেই হোমিওপ্যাথিক বিশেষজ্ঞদের সাথে পরামর্শ করে সম্ভাব্য কিছু প্রতিকার ও প্রতিষেধকমূলক ঔষধ প্রস্তাব করেছিলেন, সেগুলো ব্যবহারের বিষয়ে পুনরায় স্মরণ করান এবং দোয়া করেন যেন আল্লাহ্ তা’লা এসব ঔষধে আরোগ্য দান করেন। এর সাথে কিছু সতর্কতামূলক পদক্ষেপ নেয়ার বিষয়েও হুযূর দিকনির্দেশনা প্রদান করেন। একটি হল, জনসমাবেশ এড়িয়ে চলা। মসজিদে আসার ক্ষেত্রেও সতর্ক হওয়া উচিত; যদি কারও জ্বর থাকে, শরীর দুর্বল হতে থাকে, হাঁচি-সর্দি-কাশি ইত্যাদিতে আক্রান্ত হয়- যা করোনার লক্ষণ, তবে মসজিদে আসা উচিত নয় এবং ডাক্তার দেখিয়ে নিশ্চিত হওয়া উচিত। মসজিদে বা অন্যান্য স্থানেও হাঁচি দিতে গেলে রুমাল ব্যবহার করা উচিত। হাত পরিষ্কার রাখার জন্য স্যানিটাইজার ব্যবহার করতে হবে, ময়লা হাত মুখে দেয়া যাবে না; ওযুর মাধ্যমেও হাত-নাক ইত্যাদি পরিষ্কার হয়ে থাকে। সাময়িকভাবে করমর্দন বা হ্যান্ডশেক থেকে বিরত থাকতে বলা হয়েছে, সতর্কতার খাতিরে এটিও আপাততঃ মেনে চলতে হবে। আর সার্বিকভাবে অনেক বেশি দোয়া করা উচিত যেন আল্লাহ্ তা’লা সবাইকে নিরাপদ রাখেন এবং অতিদ্রুত এই মহামারীর প্রকোপ থেকে মানুষ মুক্তি লাভ করে। প্রাসঙ্গিকভাবে হুযূর মসজিদের আদব এবং অধিকার সম্পর্কে আরও কিছু নির্দেশনা প্রদান করেন, যেমন: যারা মোজা পরে আসেন তারা যেন দৈনিক মোজা পরিবর্তন করেন ও ধুয়ে ফেলেন, দুর্গন্ধযুক্ত কিছু খেয়ে মসজিদে না আসেন, মসজিদে আসার পূর্বে সুগন্ধি ব্যবহার করেন ইত্যাদি। তবে করোনার বাহানায় মসজিদে আসা বন্ধ করে দেয়াও অনুচিত, সর্বাবস্থায় আল্লাহ্‌র ভয় হৃদয়ে ধারণ করে অবস্থা অনুযায়ী পদক্ষেপ নেয়া উচিত।


    খুতবার শেষদিকে হুযূর তিনটি গায়েবানা জানাযা পড়ানোর ঘোষণা দেন। প্রথম জানাযা আকিল আহমদ বাট সাহেবের পুত্র স্নেহের তানযিল আহমদ বাট-এর, যার বয়স ছিল মাত্র ১১ বছর এবং গত ২৭শে ফেব্রুয়ারি এক প্রতিবেশী মহিলা আহমদীয়াতের কারণে তাকে নির্দয়ভাবে হত্যা করে। হুযূর এই বালককে শহীদদের মাঝে গণ্য করেন। দ্বিতীয় জানাযা ডা. মুহাম্মদ আব্দুল্লাহ্ সাহেবের পুত্র ব্রিগেডিয়ার বশীর আহমদ সাহেবের, যিনি রাওয়ালপিন্ডির সাবেক জেলা আমীর; গত ১৬ই ফেব্রুয়ারি ৮৭ বছর বয়সে পরলোকগমন করেন। তৃতীয় জানাযা মুহাম্মদ দ্বীন সাহেবের পুত্র ডা. হামীদ উদ্দীন সাহেবের, যিনি গত ২৯শে ফেব্রুয়ারি মৃত্যুবরণ করেন; তার পুত্র করীম উদ্দীন শামস সাহেব, জামাতের মুরব্বী হিসেবে তানজানিয়ায় কর্মরত রয়েছেন। ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন। হুযূর মরহুমদের সংক্ষিপ্ত স্মৃতিচারণে তাদের অসাধারণ গুণাবলী, বর্ণাঢ্য কর্মময় জীবন ও অতুলনীয় সেবার উল্লেখ করেন। হুযূর মরহুমদের রূহের মাগফিরাতের জন্য দোয়া করেন এবং তাদের শোকসন্তপ্ত পরিবার যেন ধৈর্য ধারণ করতে পারে এবং তাদের আদর্শ অনুসরণ করে আরও উন্নতি লাভ করে- সেজন্য দোয়া করেন। (আমীন)

  • পুর্নাঙ্গ অনুবাদ
অন্যান্য বিষয়ভিত্তিক খুতবা