بِسۡمِ اللّٰہِ الرَّحۡمٰنِ الرَّحِیۡمِِ
২৫ অক্টোবর, ২০১৯
প্রকৃত বিশ্বাসী বা মুমিনের বৈশিষ্ট্য
মাহদীয়াবাদ, জার্মানি
  • সারমর্ম
    এই জুমু’আর খুতবার সারাংশটিতে কোনো প্রকার ত্রুটি-বিচ্যুতি থাকলে তার দায়ভার আহ্‌মদীয়া বাংলা টীম গ্রহণ করছে।

    আহমদীয়া মুসলিম জামা’তের বিশ্ব-প্রধান ও পঞ্চম খলীফাতুল মসীহ্‌ হযরত মির্যা মসরূর আহমদ (আই.) গত ২৫শে অক্টোবর, ২০১৯ জার্মানির মাহদীয়াবাদে প্রদত্ত জুমুআর খুতবায় একজন প্রকৃত বিশ্বাসী বা মুমিনের বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে আলোকপাত করেন।

    হুযূর (আই.) তাশাহহুদ, তাআ’ব্বুয ও সূরা ফাতিহা পাঠের পর সূরা হাজ্জ্ব এর ৪২ নং আয়াত পাঠ করেন যার অনুবাদ হল, “এরা সেসব মানুষ, যাদের আমরা পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠিত করলে তারা নামায কায়েম করবে এবং যাকাত দিবে আর ভালো কাজের আদেশ দিবে এবং মন্দ কাজ থেকে বারণ করবে। আর সব কাজের পরিণাম আল্লাহ্‌রই হাতে।”

    হুযূর বলেন, এই আয়াতে আল্লাহ্ তা’লা মু’মিনদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলেছেন, প্রকৃত মু’মিন তারাই যারা শক্তি লাভের পর, অক্ষমতা ও নিরাপত্তাহীন অবস্থা থেকে উত্তরণের পর স্বাধীনভাবে নিজেদের ধর্মকর্ম করার পরিস্থিতি সৃষ্টি হলে পরে নিজেদের জাগতিক কামনা-বাসনা ও ব্যক্তিস্বার্থ চরিতার্থের প্রতি মনোযোগী না হয়ে নামায প্রতিষ্ঠা করে। নিজেদের নামাযের প্রতি দৃষ্টি দেয় ও মসজিদ আবাদ করে, মানবতার সেবা করে, খোদাভীতির চেতনায় সমৃদ্ধ হয়ে গরীব-দুঃখীদের জন্য নিজেদের সম্পদ ব্যয় করে, ধর্ম-প্রচারের জন্য ত্যাগ স্বীকার করে, আল্লাহ্‌র ধর্ম- প্রচারের নিমিত্তে নিজেদের সম্পদ ব্যয় করে সম্পদকে পবিত্র করে, নিজেরাও সৎকর্মের প্রতি মনোযোগী হয় এবং অন্যদেরকেও সৎকর্ম করার এবং আল্লাহ্ ও তাঁর বান্দাদের প্রাপ্য অধিকার প্রদানের প্রতি মনোযোগী করে, মন্দকর্ম থেকে নিজেরাও বিরত থাকে এবং অন্যদেরও বারণ করে। আর যেহেতু এসব কর্ম আল্লাহ্‌র ভয়কে দৃষ্টিপটে রেখে, তাঁর নির্দেশ পালনার্থে করে, সেজন্য আল্লাহ্ তা’লাও তাদের কর্মের সর্বোত্তম ফলাফল সৃষ্টি করেন। যে কাজ খোদা তা’লার নির্দেশে, হৃদয়ে তাঁর ভীতি লালন করে করা হয়- নিঃসন্দেহে সেই কাজের পরিণতি উত্তম-ই হবে। হুযূর বলেন, এই মূলনীতিটি যদি আমরা সবাই বুঝতে সক্ষম হই, তাহলে আমরা ক্রমাগত আল্লাহ্ তা’লার কৃপারাজি অর্জনকারীতে পরিণত হব।

    হুযূর বলেন, আপনারা এখানে মাহদীয়াবাদে মসজিদ বানিয়েছেন, এছাড়াও বিগত দিনগুলোতে ফুলডা ও গিসেনেও মসজিদ উদ্বোধন করা হয়েছে; জার্মানির জামা’ত শত মসজিদ প্রকল্পের অধীনে বিভিন্ন স্থানে মসজিদ নির্মাণের সৌভাগ্য লাভ করছে এবং এক্ষেত্রে আর্থিক ত্যাগ স্বীকারেরও সৌভাগ্য পাচ্ছে; তারা আর্থিক কুরবানী করছেন কারণ পাকিস্তান থেকে এখানে আসায় তাদের আর্থিক অবস্থায় উন্নতি হয়েছে, তাই তারা নামায প্রতিষ্ঠার জন্য মসজিদ নির্মাণ করছেন। পাকিস্তানে তাদের ধর্মীয় স্বাধীনতা ছিল না, এখানে তা রয়েছে; এখানে তারা স্বাধীনভাবে ইবাদত-বন্দেগী করতে পারেন। কাজেই, আমাদেরকে আল্লাহ্ তা’লার ইবাদতের দায়িত্ব পালনের প্রতি, আল্লাহ্‌র বান্দাদের প্রাপ্য অধিকার প্রদানের ও হযরত মসীহ্ মওউদ (আ.)-এর হাতে বয়আতের দাবী পূরণার্থে নিজেদের চারিত্রিক ও আধ্যাত্মিক অবস্থায় উন্নতি সাধন করার প্রতি মনোযোগী হতে হবে। এখানে বসবাসকারী আহমদীদের সর্বদা এই চিন্তা করা ও এর জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা করা উচিত, নতুবা এই মসজিদ নির্মাণ বৃথা। প্রত্যেক আহমদীর এটা স্মরণ রাখতে হবে যে, কেবল মসজিদ নির্মাণ করলেই এর উদ্দেশ্য পূর্ণ হয়ে যায় না, বরং আল্লাহ্‌র সাক্ষাত লাভের বাসনায় কায়োমনবাক্যে ইবাদত করা, নামায প্রতিষ্ঠা করা অর্থাৎ বাজামাত নামায পড়া আবশ্যক। নামাযে যদি মনোযোগ স্থির না থাকে, তবে সাথে সাথে নামাযে মনোযোগ ফিরিয়ে আনা, আর এমনভাবে নামায পড়া যাতে আল্লাহ্‌র সাক্ষাৎ লাভ হয়। হযরত মসীহ্ মওউদ (আ.) কুরআন থেকে মুত্তাকীর বৈশিষ্ট্য তুলে ধরতে গিয়ে নামায প্রতিষ্ঠার বিষয়টি উপস্থাপন করে বলেন, মু’মিন নামায দাঁড় করায়; অর্থাৎ নামায দোদুল্যমান হয়ে পড়ে, হৃদয়ের কুমন্ত্রণা ও প্ররোচনা তার মনসংযোগে চিড় ধরায়, কিন্তু স্মরণ হওয়া মাত্রই সে সাথে সাথে নামাযে মনোযোগ ফিরিয়ে আনে। আর প্রকৃত অর্থে সুপথ প্রাপ্তির পর নামায তার প্রাণ হয়ে যায়, তার আত্মার খোরাক হয়ে যায়, যা ছাড়া সে বাঁচতেই পারে না; আর শুধু তা-ই নয়, বরং এতে সে পরম স্বাদ ও তৃপ্তি পায়, যেমনটি প্রচ- তৃষ্ণার সময় একজন পিপাসার্ত মানুষ ঠাণ্ডা পানির মাঝে পায়। হাদীসেও এই বিষয়ের প্রতিই ইঙ্গিত করে বলা হয়েছে- নামায মু’মিনের জন্য মিরাজস্বরূপ, অর্থাৎ তা মানুষকে খোদা তা’লার নৈকট্য লাভে ধন্য করে। কিন্তু এই অবস্থা চট করে অর্জিত হয় না, এর জন্য ধৈর্য ও অধ্যবসায় প্রয়োজন, দীর্ঘকাল চেষ্টা-সাধনার পর একসময় আল্লাহ্ তা’লার কৃপায় মানুষ এই মার্গ বা পরাকাষ্ঠা অর্জন করে। তাই হতাশ না হয়ে অনবরত চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে। সাধারণতঃ এটাই দেখা যায় যে, মানুষ ত্বরাপ্রবণ, দ্রুত ফলাফল না পেলে হতাশ হয়ে ক্ষান্ত দেয়, কিন্তু আল্লাহ্ তা’লার কাছে চাওয়ারও কিছু নিয়ম-কানুন আছে। নামাযে দোয়া ও ক্রন্দন করতে হবে, একান্ত বিনয় ও দীনতার সাথে আল্লাহ্‌র কাছে সাহায্য প্রার্থনা করতে হবে ও তাঁর নৈকট্য যাচনা করতে হবে। নামাযে নিজের ভাষায়ও দোয়া করতে হবে, আর আল্লাহ্ তা’লার শেখানো দোয়াও করতে হবে; আল্লাহ্ তা’লা যে সূরা ফাতিহা শিখিয়েছেন, তা একটি পরিপূর্ণ দোয়া। এর প্রতিটি বাক্য অত্যন্ত গভীর প্রজ্ঞা ও তাৎপর্যপূর্ণ প্রার্থনা। পরম বিনয় ও আকুতির সাথে এই দোয়া করতে থাকলে আল্লাহ্ তা’লা অবশ্যই কৃপা করবেন ও স্বীয় অপার দানে ভূষিত করবেন। বস্তুতঃ দোয়া কবুল হওয়ার পথে আমাদের পক্ষ থেকেই কতেক প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হয়ে যায়, সেই অন্তরায় দূর করতে হবে, সেই ত্রুটি সংশোধন করতে হবে, তবেই দোয়া গৃহীত হবে। কেননা আল্লাহ্ তা’লা ঘোষণা দিয়ে রেখেছেন, বান্দা যখন তাঁর দিকে একপা অগ্রসর হয় তখন তিনি দু’পা তার দিকে অগ্রসর হন, বান্দা হেঁটে অগ্রসর হলে আল্লাহ্ দৌড়ে আসেন। অতএব আল্লাহ্কে পাওয়ার জন্য একনিষ্ঠভাবে চেষ্টা করতে হবে। আর চেষ্টা করলেই আল্লাহ্ তা’লাকে পাওয়া যায়; তিনি ঘোষণা দিয়ে রেখেছেন- ‘ওয়াল্লাযিনা জাহাদু ফিনা লানাহদিইয়্যান্নাহুম সুবুলানা’ অর্থাৎ ‘যারা আমাদের পথে চেষ্টা করে, তাদেরকে আমরা আমাদের পথ প্রদর্শন করি’। তবে এর জন্য চেষ্টার সাথে সাথে আল্লাহ্র সাহায্যেরও প্রয়োজন, কেবলমাত্র তবেই সফলতা লাভ হয়। এজন্যই সূরা ফাতিহায় সাহায্য চাওয়ার দোয়াও শেখানো হয়েছে- ‘ইয়্যাকা নাস্তাঈন’ অর্থাৎ ‘আমরা কেবল তোমার কাছেই সাহায্য প্রার্থনা করি’। এমন অনেক লোক আছে যারা একদিকে ত্রিশ-চল্লিশ বছর পর্যন্ত নামায-রোযা করেছে, অথচ বলে যে ‘আমরা ঐশী সাহায্য লাভ করি না’। এর কারণ হল, তাদের ইবাদত প্রথাগত, প্রকৃত ইবাদত নয়। নামায তো সেটি, যা ফলাফল বয়ে আনে, আল্লাহ্‌র নিকটবর্তী করে। যদি দোয়া গৃহীত না হয়, তবে বুঝতে হবে- তার নামায প্রকৃত নামায নয়। মহানবী (সা.)-এর এই বাণী আমাদের সর্বদা দৃষ্টিপটে রাখতে হবে- ঈমান ও কুফরের মাঝে পার্থক্য নির্ণয় সূচক হল নামায; অর্থাৎ নামায পরিত্যাগ করলে তা কুফরের পরিচায়ক। আর আল্লাহ্ তা’লা কেবল নামায পড়ার নির্দেশই দেন নি, বরং বাজামাত পড়ার নির্দেশ দিয়েছেন, বৈধ কারণ ব্যতিরেকে একা নামায পড়া যথার্থ নয়। আর বাজামাত নামাযে সাতাশগুণ বেশি পুণ্য রাখা হয়েছে। এসব বিষয় আমাদের মনে রাখা আবশ্যক। একইসাথে নিজেদের স্ত্রী-সন্তানদের সংশোধন করাও আবশ্যক, এর জন্য আল্লাহ্ তা’লা দোয়াও শিখিয়েছেন- ‘আসলিহ্ লি ফী যুররিয়্যাতি’ অর্থাৎ হে আল্লাহ্! আমার স্ত্রী-সন্তানদের সংশোধন করে দাও। কাজেই, তাদের সংশোধনের প্রতিও মনোযোগী হওয়া দরকার এবং নিজের কর্মের সংশোধনের পাশাপাশি তাদেরকেও উপদেশ প্রদান করা প্রয়োজন।

    হুযূর দোয়া করেন- আল্লাহ্ তা’লা আমাদের তৌফিক দিন যেন আমরা নিজেদের অবস্থায় পবিত্র পরিবর্তন সৃষ্টির সাথে সাথে নিজেদের নামাযকে প্রতিষ্ঠিত করি ও সেটিকে উচ্চ মানে অধিষ্ঠিত করি, নিজেদের সম্পদও পবিত্র করি, নিজেদের চরিত্র উন্নত করি, পুণ্যকর্ম সম্পাদনকারী ও পুণ্যের বিস্তারকারী হই, মন্দকর্ম থেকে বিরত থাকি এবং নিজেদের বংশধরদেরও মন্দকর্ম থেকে বিরত রাখি আর নিজেদের আশেপাশের লোকদেরও বিরত রাখি, মসজিদ নির্মাণের মাধ্যমে এই দেশের নাগরিকদের কাছে ইসলামের প্রকৃত বাণী পৌঁছাই এবং তাদেরকে এক-অদ্বিতীয় আল্লাহ্র ইবাদতকারী বানাই। আর এটি কেবল তখনই সম্ভব যখন আমরা নিজেদের ভেতরও উন্নত পরিবর্তন সৃষ্টি করব; আল্লাহ্ তা’লা আমাদের সেই তৌফিক দান করুন। (আমীন)

    এরপর হুযূর মসজিদ সংক্রান্ত কিছু তথ্য-উপাত্তও উপস্থাপন করেন। দ্বিতল এই মসজিদের মোট আয়তন ৩৮৫ বর্গমিটার, এখানে ২১০ জন মুসল্লী একত্রে নামায পড়তে সক্ষম। উপরতলায় পুরুষদের ও নিচতলায় মহিলাদের নামাযের ব্যবস্থা রয়েছে। এই মসজিদ নির্মাণে ৫ লাখ ৬০ হাজার ইউরো ব্যয় হয়েছে, যার মধ্যে দু’লক্ষাধিক ইউরো স্থানীয় আহমদীরা প্রদান করেছেন, অবশিষ্ট অর্থ শত মসজিদ প্রকল্পের খাত থেকে বহন করা হয়েছে। হুযূর দোয়া করেন, আল্লাহ্ তা’লা সকল আর্থিক ত্যাগ স্বীকারকারীর সম্পদ ও জনবলে বরকত দান করুন, আর মসজিদ নির্মাণের পর তারা পূর্বের চেয়ে আরো বেশি ইবাদতের দায়িত্ব পালনকারী হোন। (আমীন)

  • পুর্নাঙ্গ অনুবাদ
বিষয়ঃ
শেয়ার করুনঃ
অন্যান্য বিষয়ভিত্তিক খুতবা