بِسۡمِ اللّٰہِ الرَّحۡمٰنِ الرَّحِیۡمِِ
২৪ জুলাই, ২০২০
শ্রেষ্ঠ মহাপুরুষ – নিষ্ঠাবান বদরী সাহাবীগণ
মসজিদ মুবারক, ইসলামাবাদ, টিলফোর্ড, লন্ডন
  • সারমর্ম
    এই জুমু’আর খুতবার সারাংশটিতে কোনো প্রকার ত্রুটি-বিচ্যুতি থাকলে তার দায়ভার আহ্‌মদীয়া বাংলা টীম গ্রহণ করছে।

    আহমদীয়া মুসলিম জামা’তের বিশ্ব-প্রধান ও পঞ্চম খলীফাতুল মসীহ্‌ হযরত মির্যা মসরূর আহমদ (আই.) গত ২৪শে জুলাই, ২০২০ ইসলামাবাদের মসজিদে মুবারকে প্রদত্ত জুমুআর খুতবায় পূর্বের ধারা অনুসরণে নিষ্ঠাবান বদরী সাহাবীদের বর্ণাঢ্য জীবনের স্মৃতিচারণ করেন। এ খুতবায়ও তিনি হযরত সা’দ বিন আবি ওয়াক্কাস (রা.)’র জীবনের স্মৃতিচারণ করেন।


    তাশাহহুদ, তাআ’ব্বুয ও সূরা ফাতিহা পাঠের পর হুযূর (আই.) বলেন, হযরত সা’দ বিন আবি ওয়াক্কাস (রা.)’র স্মৃতিচারণ করা হচ্ছিল; হযরত সা’দ মহানবী (সা.)-এর সাথে বদর, ওহুদ, খন্দক, হুদাইবিয়া, খায়বার ও মক্কা-বিজয়সহ সকল অভিযানে অংশগ্রহণ করেছিলেন। তিনি মহানবী (সা.)-এর একজন সেরা তীরন্দাজ ছিলেন। তার সম্পর্কে একটি বর্ণনায় একথার উল্লেখ রয়েছে যে, একবার কোন এক যুদ্ধের এক পর্যায়ে হযরত তালহা ও হযরত সা’দ (রা.) ছাড়া আর কেউ মহানবী (সা.)-এর পাশে ছিলেন না। কতিপয় যুদ্ধাভিযানে সাহাবীদের খাবারের অবস্থা সম্পর্কে বলতে গিয়ে হযরত সা’দ (রা.) বলেন, ‘আমরা মহানবী (সা.)-এর সাথে যুদ্ধে যেতাম, তখনকার অবস্থা এমন ছিল যে, গাছের পাতা ছাড়া আমাদের খাবারের জন্য আর কিছুই থাকত না; আমাদের একেকজনের মল উট বা ছাগলের নাদির মত হতো।’ কখনো কখনো তারা বাবলা গাছের পাতা খেয়ে থাকতেন।


    হযরত সা’দ বিন আবি ওয়াক্কাস (সা.) সেই প্রথম ব্যক্তি যিনি আল্লাহ্‌র পথে বিরোধীদের রক্ত ঝরিয়েছিলেন এবং আল্লাহ্‌র পথে প্রথম তীরও তিনি-ই ছুঁড়েছিলেন; হযরত উবায়দা বিন হারেসের নেতৃত্বে প্রেরিত অভিযানে তিনি ইসলামের পক্ষে প্রথম তীর নিক্ষেপ করেছিলেন। দ্বিতীয় হিজরীর রবিউল আউয়াল মাসে এই অভিযান প্রেরিত হয়েছিল। ইতোপূর্বেও এ ঘটনাটি হুযূর (আই.) বর্ণনা করেছেন, হযরত সা’দের স্মৃতিচারণে আজ আবার তা পুনরুল্লেখ করেন। এই অভিযানে কোন হতাহতের ঘটনা ঘটেনি, কেবল তীর বিনিময় হয়েছিল। কাফিররা ইকরামা বিন আবু জাহলের নেতৃত্বে এসেছিল। মুসলমানরা সংখ্যায় মাত্র ষাটজন ছিলেন, কিন্তু ইকরামা ভেবেছিল হয়তো তাদের পেছনে বড় সৈন্যদল আসছে, তাই তারা ভয়ে চম্পট দেয়। তবে তার আগে হযরত মিকদাদ বিন আমর ও হযরত উতবা বিন গাযওয়ান কাফিরদের দল ছেড়ে এসে মুসলমানদের সাথে যোগ দেন; তারা দু’জনই মুসলমান ছিলেন এবং যেহেতু কাফিরদের চাপে তারা হিজরত করতে পারছিলেন না, সেজন্য তারা এই সংকল্প নিয়েই কাফিরদের দলের সাথে রওয়ানা হয়েছিলেন যেন সুযোগমত মুসলমানদের সাথে এসে যোগ দিতে পারেন।


    ২য় হিজরীর জমাদিউল উলা মাসে মহানবী (সা.) হযরত সা’দ বিন আবি ওয়াক্কাস (রা.)-কে আটজন মুহাজিরের একটি দলের নেতৃত্ব দিয়ে ‘খাররার’ নামক স্থানে কুরাইশদের ব্যাপারে তথ্য-সংগ্রহের জন্য প্রেরণ করেন। এই অভিযানে শত্রুদের সাথে কোন সাক্ষাৎ হয় নি এবং রক্তপাতও হয় নি। একই বছর জমাদিউল আখের মাসে হযরত আব্দুল্লাহ্ বিন জাহশ (রা.)’র নেতৃত্বে প্রেরিত যুদ্ধাভিযানেও হযরত সা’দ (রা.) অংশগ্রহণ করেছিলেন। হুযূর (আই.) এই ঘটনাটিও ইতোপূর্বে কোন এক খুতবায় বর্ণনা করেছেন। মহানবী (সা.)-এর নির্দেশে আটজন সাহাবীর এই দল নাখলা অভিমুখে যাত্রা করেন; পথিমধ্যে হযরত উতবা বিন গাযওয়ান ও সা’দ বিন আবি ওয়াক্কাসের উট হারিয়ে যায়, উট খুঁজতে গিয়ে তারা দলছুট হয়ে পড়েন। বাকি ছয়জন অগ্রসর হলে একস্থানে কুরাইশদের একটি দলের সাথে তাদের সাক্ষাৎ হয়ে যায়। যেহেতু তাদেরকে বাধা না দিলে কুরাইশরাই সদলবলে তাদের ওপর আক্রমণ করতো, সেজন্য সাহাবীরা প্রথমে তাদের ওপর আক্রমণ করেন; কাফিরদের একজন নিহত হয় ও দু’জন বন্দী হয়, কিন্তু একজন পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়। সাহাবীরা বন্দীদের নিয়ে দ্রুত মদীনায় ফেরত আসেন। মহানবী (সা.) যখন এটি জানতে পারেন তখন অত্যন্ত অসন্তুষ্ট হন এবং তিনি (সা.) যুদ্ধলদ্ধ সম্পদ নিতেও অস্বীকৃতি জানান। নিহত ব্যক্তি আমর বিন হাযরামি কুরাইশদের এক সম্ভ্রান্ত নেতা ছিল; কুরাইশরা এ নিয়ে হৈচৈ শুরু করে যে, যুদ্ধের জন্য নিষিদ্ধ মাসে তাদের ওপর আক্রমণ করা হয়েছে। তারা মদীনায় এসে অভিযোগ করে এবং তাদের বন্দীদের মুক্ত করার দাবী জানায়। যেহেতু হযরত সা’দ ও উতবা (রা.) তখনও মদীনায় ফেরেন নি এবং মহানবী (সা.) তাদের দু’জনের নিরাপত্তা নিয়ে শংকিত ছিলেন, তাই তিনি (সা.) বলেন, তারা ফিরে এলে বন্দীদের ছেড়ে দেবেন আর তিনি (সা.) পরে তাদের মুক্তও করে দেন। কিন্তু তাদের একজন মদীনার ইসলামী পরিবেশ দেখে প্রভাবিত হন ও ইসলাম গ্রহণ করেন, পরে তিনি বি’রে মউনার ঘটনায় শাহাদতও বরণ করেন। প্রাচ্যবিদ মার্গুলিসের মতে হযরত সা’দ ও উতবা নাকি ভীরু ছিলেন ও ইচ্ছাকৃতভাবে নিজেদের উট ছেড়ে দিয়েছিলেন; অথচ ইতিহাস সাক্ষী, তারা সকল যুদ্ধে বীরত্বের সাথে লড়েছেন। হযরত উতবা বিন গাযওয়ান বি’রে মউনায় বীরত্বের সাথে লড়াই করে শাহাদতবরণ করেন, আর হযরত সা’দ ইরাক-জয়ী সেনাপতি ছিলেন। তাই তাদের সম্পর্কে এমন কথা বলা অপলাপ বৈ কিছুই নয়।


    বদরের যুদ্ধে হযরত সা’দ (রা.)’র বীরত্ব সম্পর্কে বর্ণিত হয়েছে, সেদিন তিনি পদাতিক হওয়া সত্ত্বেও অশ্বারোহীর মত ক্ষিপ্র ছিলেন; এজন্য তাকে ‘ফারিসুল ইসলাম’ বা ইসলামের অশ্বারোহী বলা হতো। ওহুদের যুদ্ধের দিন হযরত সা’দ (রা.) সেই স্বল্প সংখ্যক সাহাবীর একজন ছিলেন যারা চরম বিপর্যয়ের সময় মহানবী (সা.)-এর পাশে থেকে দৃঢ়-অবিচলতার সাথে লড়াই করছিলেন। তার ভাই উতবা বিন আবি ওয়াক্কাস মুশরিকদের পক্ষ হয়ে যুদ্ধে অংশ নিয়েছিল এবং উতবা সেই দুর্ভাগা- যে মহানবী (সা.)-এর ওপর উপর্যুপরি আক্রমণ করে তাঁর (সা.) পবিত্র দু’টি দাঁত শহীদ করেছিল ও তাঁর পবিত্র মুখম-ল রক্তেরঞ্জিত করেছিল। হযরত সা’দ (রা.) যখন তা জানতে পারেন, রাগে তার রক্ত টগবগ করে ফুটতে থাকে। হযরত সা’দ (রা.) বলেন, তিনি তখন নিজ ভাইকে হত্যা করতে এতটাই উদগ্রীব হয়ে উঠেছিলেন যে, জীবনে হয়তো কখনও অন্য কোন বিষয়ে তিনি এতটা উৎসুক হন নি। তিনি দু’ দু’বার শত্রুব্যূহ ভেদ করে উতবাকে হত্যার জন্য আক্রমণ করেন, কিন্তু উতবা প্রতিবারই ভাইকে দেখে শেয়ালের মত পালিয়ে যায়। তৃতীয়বার চেষ্টা করার উপক্রম করলে মহানবী (সা.) তাকে স্নেহের সাথে বলেন, ‘হে আল্লাহ্‌র বান্দা! তোমার কি প্রাণ বিসর্জন দিতে ইচ্ছা হচ্ছে?’ তাঁর (সা.) এই কথা শুনে হযরত সা’দ নিবৃত্ত হন। ওহুদের যুদ্ধের দিন বিপর্যয়ের সময় যখন তারা মাত্র অল্প কয়েকজন মহানবী (সা.)-এর পাশে ছিলেন, তখন স্বয়ং মহানবী (সা.) হযরত সা’দের হাতে একের পর এক তীর তুলে দিচ্ছিলেন এবং সা’দ উপর্যুপরি তীর নিক্ষেপ করে যাচ্ছিলেন। এক পর্যায়ে মহানবী (সা.) তাকে বলেছিলেন, ‘আমার মা-বাবা তোমার জন্য উৎসর্গিত, তুমি তীর ছুঁড়তে থাক!’ হযরত সা’দ (রা.) আমৃত্যু একথা গর্বের সাথে স্মরণ করতেন। এক বর্ণনামতে ওহুদের যুদ্ধের দিন হযরত সা’দ (রা.) এক হাজার তীর ছুঁড়েছিলেন।


    হুদাইবিয়ার সন্ধির সময় সন্ধিপত্রে যে সাহাবীরা সাক্ষী হিসেবে স্বাক্ষর করেছিলেন, হযরত সা’দ (রা.) তাদের অন্যতম ছিলেন। বিদায় হজ্জ্বের সময় তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং বলতে গেলে মৃত্যুশয্যায় ছিলেন। তিনি তার যাবতীয় সম্পদ ইসলামের সেবায় ওসীয়্যত করতে চান। কিন্তু মহানবী (সা.) তা জানতে পেরে নাকচ করে দেন। অবশেষে হুযূর (সা.) তাকে সর্বোচ্চ এক-তৃতীয়াংশ ওসীয়্যত করার অনুমতি দেন, কিন্তু একইসাথে এ-ও বলে দেন- এক-তৃতীয়াংশও অনেক বেশি, আর নিজ সন্তানদেরকে এমন অবস্থায় রেখে যাওয়া মোটেই সমীচীন নয় যে, তাদেরকে অন্যের কাছে হাত পাততে হয়। হযরত সা’দ শংকিত ছিলেন, তিনি হয়তো মদীনায় ফিরে যেতে পারবেন না এবং তার হিজরত অপূর্ণ থেকে যাবে, কিন্তু মহানবী (সা.) তাকে আশ্বস্ত করেন যে, তার কর্মের ভিত্তিতে তার হিজরত মোটেও উপেক্ষিত হবে না; একইসাথে এ-ও বলেন, তিনি (সা.) আশা করেন- সা’দ তাঁর (সা.) পরেও জীবিত থাকবেন এবং জাতিসমূহ তার দ্বারা কল্যাণমণ্ডিত হবে। বস্তুতঃ মহানবী (সা.)-এর এই ধারণাই সত্য প্রমাণিত হয়েছিল। মহানবী (সা.) তার চিকিৎসারও সুব্যবস্থা করেন এবং নির্দেশ দেন, তিনি যদি মক্কাতে মারাও যান, তবুও যেন তাকে সেখানে দাফন করা না হয়, বরং মদীনায় নিয়ে গিয়ে দাফন করা হয়।


    হযরত উমর (রা.)’র খিলাফতকালে হযরত সা’দ (রা.)-কে আল্লাহ্ তা’লা ইরাক জয়ের সৌভাগ্য দান করেন। হুযূর (আই.) ইরাক জয়ের বিস্তারিত ইতিহাস খুতবায় তুলে ধরেন। অতঃপর হুযূর (আই.) বলেন, হযরত সা’দের অবশিষ্ট স্মৃতিচারণ পরবর্তী খুতবায় করা হবে (ইনশাআল্লাহ্)।


    খুতবার শেষদিকে হুযূর (আই.) সম্প্রতি পরলোকগত কয়েকজন নিষ্ঠাবান আহমদীর গায়েবানা জানাযা পড়ানোর ঘোষণা দেন এবং তাদের বর্ণাঢ্য কর্মময় জীবনের সংক্ষিপ্ত স্মৃতিচারণ করেন; তাদের মধ্যে প্রথম হলেন, মোকাররমা বুশরা আকরাম সাহেবা, দ্বিতীয় মোকাররম ইকবাল আহমদ নাসের সাহেব, তৃতীয় মোকররমা গোলাম ফাতেমা ফাহমিদা সাহেবা, চতুর্থ মোকাররম মাহমুদ আহমদ আনোয়ার সাহেব ও পঞ্চমজন হলেন সিরিয়া নিবাসী জামাতের নিষ্ঠাবান সেবক মোকাররম সালিম হাসান আল্ জাবী সাহেব। হুযূর তাদের সবার বিদেহী আত্মার শান্তি ও মাগফিরাত কামনা করেন আর তাদের আধ্যাত্মিক পদমর্যাদা উন্নীত হওয়ার জন্য দোয়া করেন। (আমীন)

  • পুর্নাঙ্গ অনুবাদ