بِسۡمِ اللّٰہِ الرَّحۡمٰنِ الرَّحِیۡمِِ
১৪ আগস্ট, ২০২০
শ্রেষ্ঠ মহাপুরুষ – নিষ্ঠাবান বদরী সাহাবীগণ
মসজিদ মুবারক, ইসলামাবাদ, টিলফোর্ড, লন্ডন
  • সারমর্ম
    এই জুমু’আর খুতবার সারাংশটিতে কোনো প্রকার ত্রুটি-বিচ্যুতি থাকলে তার দায়ভার আহ্‌মদীয়া বাংলা টীম গ্রহণ করছে।

    আহমদীয়া মুসলিম জামা’তের বিশ্ব-প্রধান ও পঞ্চম খলীফাতুল মসীহ্‌ হযরত মির্যা মসরূর আহমদ (আই.) গত ১৪ই আগস্ট, ২০২০ ইসলামাবাদের মসজিদে মুবারকে প্রদত্ত জুমুআর খুতবায় পূর্বের ধারা অনুসরণে নিষ্ঠাবান বদরী সাহাবীদের বর্ণাঢ্য জীবনের স্মৃতিচারণ করেন। এ খুতবায়ও তিনি হযরত সা’দ বিন আবি ওয়াক্কাস (রা.)’র জীবনের স্মৃতিচারণ করেন।


    তাশাহহুদ, তাআ’ব্বুয ও সূরা ফাতিহা পাঠের পর হুযূর (আই.) বলেন, দুই শুক্রবার পূর্বে আমি সাহাবীদের যে স্মৃতিচারণ করছিলাম, এতে হযরত সা’দ বিন আবি ওয়াক্কাসের স্মৃতিচারণে তার যুদ্ধাভিযান সম্পর্কে আলোচনা হচ্ছিল। যুদ্ধের সময়ের একটি ঘটনা হুযূর (আই.) ইতিহাসগ্রন্থ ও হযরত মুসলেহ্ মওউদ (রা.)-এর বরাতে তুলে ধরেন। হযরত উমর (রা.) হযরত সা’দকে ইরানের সাথে যুদ্ধে মুসলিম বাহিনীর সেনাপ্রধান নিযুক্ত করেন। ঘটনাচক্রে সা’দের ঊরূতে তখন একটি ফোঁড়া বা বাগি হয় এবং সেটি দীর্ঘদিন তাকে ভোগাতে থাকে, অনেক চিকিৎসা সত্ত্বেও তা ভালো হচ্ছিল না। অবশেষে তিনি ভাবেন, তিনি যদি এভাবে বিছানায় পড়ে থাকেন তাহলে মুসলিম বাহিনী তার অনুপস্থিতিতে মনোবল হারিয়ে ফেলতে পারে- তাই তিনি একটি গাছের ওপরে মাচা বাঁধান এবং অন্যদের সাহায্যে সেই মাচায় চড়ে বসেন যেন মুসলমান সৈন্যরা তাকে দেখতে পান এবং অনুভব করেন যে, তাদের নেতা তাদের সাথেই আছেন। সে দিনগুলোতে একজন আরব নেতা আবু মেহজেন সাকফী মদ্যপানের দায়ে মদীনা থেকে বহিষ্কারের শাস্তি পেয়ে এখানে চলে এসেছিলেন। এখানে এসে আবারও মদ্যপান করায় হযরত সা’দ বিন আবি ওয়াক্কাস (রা.) তাকে বেত্রাঘাতের শাস্তি দেন ও শিকলাবদ্ধ করে রাখেন। ইসলামের ইতিহাসে ঐ বছরটি বিপদের বছর বলে পরিচিত, কারণ সেই যুদ্ধে মুসলমানদের অনেক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল। একদিন শত্রুপক্ষের হাতির আক্রমণে মুসলমানদের ঘোড়াগুলো নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়লে অনেক মুসলমান নদীতে ডুবে শাহাদতবরণ করেন, কারণ অধিকাংশ আরব সাঁতার জানত না। মুসলিম সেনারা যুদ্ধক্ষেত্র থেকে ফিরে আবু মেহজেন যে কক্ষে বন্দী ছিলেন, সেই কক্ষের কাছে বসেই যুদ্ধ সম্পর্কে আলোচনা করতেন। আবু মেহজেন যদিও মদ্যপানের মত ঘৃণ্য কাজ করে ফেলেছিলেন, কারণ তিনি নবাগত মুসলমান ছিলেন এবং আরবদের বহু বছরের পুরোনো মদ্যপানের অভ্যাস সহজে ছাড়তে পারছিলেন না, কিন্তু তিনি যোদ্ধা হিসেবে অনেক বড় বীর ছিলেন এবং ইসলামের প্রতি তার গভীর ভালোবাসাও ছিল। তার মনে খুব আক্ষেপ হতে থাকে যে, হায়! আজ যদি আমি মুক্ত থাকতাম তাহলে ইসলামের পক্ষে লড়াই করার ও ইসলামকে সাহায্য করার সুযোগ পেতাম। হযরত সা’দের স্ত্রী হযরত সালমা বিনতে হাফসা একদিন তাকে এভাবে আক্ষেপ করতে এবং যুদ্ধে অংশগ্রহণের ব্যাপারে তার প্রবল আগ্রহ দেখে তাকে সাময়িকভাবে মুক্ত করে দেন। অপর বর্ণনামতে আবু মেহজেন হযরত সা’দের এক দাসী যাহরার কাছে অনুরোধ করেন সে যেন তার বাঁধন খুলে দেয় যাতে সে যুদ্ধে যেতে পারে; একইসাথে সে কসমও খায়, যদি সে প্রাণে বেঁচে ফিরতে পারে, তাহলে ফিরে এসেই আবার লোহার বেড়ি পরে নেবে। সেই দাসী তখন তাকে মুক্ত করে দেয়। আবু মেহজেন হযরত সা’দের ঘোড়া নিয়ে যুদ্ধে চলে যায় এবং বীরবিক্রমে যুদ্ধ করতে থাকে। যদিও তার মুখ ঢাকা ছিল তবুও হযরত সা’দ (রা.) তাকে দূর থেকে দেখেই চিনতে পারেন। যুদ্ধশেষে তিনি ফিরে আসেন এবং শিকলাবদ্ধ হন। তখন হযরত সা’দ (রা.) হযরত উমর (রা.)-এর সাথে পত্রযোগে পরামর্শ করে আবু মেহজেনকে জিজ্ঞেস করেন, তিনি আর কখনও মদ্যপান করবেন কি-না? আবু মেহজেন যখন বলেন, তিনি আর কখনও মদ্যপান করবেন না, তখন তাকে ছেড়ে দেয়া হয়। শুধু আবু মেহজেন-ই নন, আরবের বিখ্যাত মহিলা কবি হযরত খানসার চার পুত্রও কাদসিয়ার যুদ্ধে অনেক বীরত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন এবং মায়ের ওসীয়্যত অনুসারে নিজেদের জীবন বিসর্জন দিয়ে ইসলামের পতাকা কাদসিয়ায় উড্ডীন করে ছাড়েন। কাদসিয়া বিজয় করার পর মুসলমানরা ক্রমান্বয়ে ব্যাবিলন, কুসা, মাদায়েন প্রভৃতি শহর জয় করেন। মাদায়েন ও মুসলমানদের মাঝে যখন কেবলমাত্র দজলা নদীর দূরত্ব বাকি ছিল, তখন ইরানীরা মাদায়েনে প্রবেশের সবগুলো সেতু ভেঙে ফেলে। হযরত সা’দ (রা.) মুসলমানদের বলেন, ‘হে মুসলমানগণ, শত্রুরা নদীর আশ্রয় নিয়েছে। এস, আমরা এটি সাঁতরে পার হই!’ বলেই ঘোড়াসহ তিনি নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়েন। মুসলমানরাও নেতার অনুসরণে তা-ই করেন এবং নদী পার হয়ে যান। তখন ইরানীরা হতচকিত হয়ে আতংকে চিৎকার শুরু করে- ‘দৈত্য এসেছে, দৈত্য!’ এবং ভয় পেয়ে তারা পালিয়ে যায়। এভাবে আহযাবের যুদ্ধের সময়ে মহানবী (সা.) দিব্যদর্শনে দেখে যে ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন, তা বাস্তবে পূর্ণ হয়; অর্থাৎ, তিনি (সা.) মাদায়েনের শ্বেত প্রাসাদগুলোর পতন দেখেছিলেন। মাদায়েন জয়ের পর হযরত সা’দ (রা.) চিঠি লিখে হযরত উমর (রা.)’র কাছে আরও অগ্রসর হওয়ার অনুমতি চাইলে খলীফা তাকে আরও অগ্রসর হওয়ার পরিবর্তে বিজিত এলাকাগুলোতে সুশাসন ও শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠার নির্দেশ দেন। ফলে তিনি মাদায়েনকে কেন্দ্র করে প্রশাসন ব্যবস্থা সুসংহত করার চেষ্টা করেন। পরবর্তীতে মাদায়েনের আবহাওয়া আরবদের জন্য অনুপযোগী দেখতে পেয়ে তিনি হযরত উমর (রা.)’র অনুমতিক্রমে কুফা শহরের গোড়াপত্তন করেন। কুফায় তিনি একটি মসজিদ নির্মাণ করান যেখানে একসাথে চল্লিশ হাজার মুসল্লি নামায পড়তে পারতেন।


    হযরত উমর (রা.)’র খিলাফতকালে বনু আসাদ গোত্রের লোকেরা হযরত সা’দ (রা.)’র ব্যাপারে খলীফার কাছে অভিযোগ করে যে, তিনি সঠিকভাবে নামায পড়ান না। হযরত উমর (রা.) বিষয়টি যাচাইয়ের জন্য হযরত মুহাম্মদ বিন মাসলামা (রা.)-কে প্রেরণ করেন; দেখা যায় যে অভিযোগটি সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন। তবে হযরত উমর (রা.) অন্য কোন প্রজ্ঞার অধীনে তাকে মদীনায় ডেকে পাঠান ও তার স্থলে হযরত আম্মার বিন ইয়াসের (রা.)-কে নিযুক্ত করেন। বনু আবাস গোত্রের এক ব্যক্তি উসামা বিন কাতাদা হযরত সা’দের নামে প্রকাশ্যে মিথ্যা অপবাদ দেয়ায় তিনি তার বিরুদ্ধে বদদোয়া করেন যেন আল্লাহ্ তার আয়ু দীর্ঘ করে দেন ও অপরের মুখাপেক্ষী হয়ে তাকে জীবন কাটাতে হয়। বস্তুতঃ এমনটিই হয়েছিল, আর সেই ব্যক্তি নিজেও এটা বলত- ‘আমার ওপর হযরত সা’দের বদদোয়া লেগেছে।’


    হযরত উমর (রা.)’র শাহাদতের পর হযরত উসমান (রা.)’র খিলাফতকালে হযরত সা’দ (রা.) পুনরায় কুফার গভর্নর নিযুক্ত হন এবং তিন বছর অত্যন্ত নিষ্ঠার সাথে দায়িত্ব পালন করেন। পরবর্তীতে হযরত আব্দুল্লাহ্ বিন মাসউদ (রা.)’র সাথে তার মতবিরোধ হলে খলীফা উসমান (রা.) তাকে অব্যাহতি প্রদান করেন। এই ঘটনার পর থেকে হযরত সা’দ (রা.) মদীনায় নিভৃতে জীবনযাপন শুরু করেন এবং আমৃত্যু এভাবে নিভৃতেই থাকেন। এরই মধ্যে মুসলমানদের মধ্যে বিশৃঙ্খলা শুরু হয়, হযরত উসমান (রা.)’র শাহাদতের ঘটনা ঘটে, মুসলমান মুসলমানের বিরুদ্ধে তরবারী ধারণ করে- কিন্তু তবুও তিনি বের হন নি বা কারও পক্ষ নেন নি। কারণ তিনি মহানবী (সা.)-এর কাছ থেকে এরূপ যুগের ভবিষ্যদ্বাণী শুনেছিলেন। তিনি কোন অবস্থাতেই ভুলক্রমে কোন মুসলমানের প্রাণ সংহার করতে রাজি ছিলেন না। কেউ তাকে যুদ্ধে অংশ নিতে বললে তিনি কেবল এটি-ই বলতেন, ‘আমাকে এমন তরবারী এনে দাও যা চিনতে পারে কে মুসলমান আর কে কাফির!’ হযরত আলী (রা.) ও আমীর মুয়াবিয়ার মধ্যে দ্বন্দ্বের যুগে হযরত আলী (রা.)’র আহ্বান সত্ত্বেও তিনি হযরত আলীর পক্ষে লড়তে রাজি হন নি। আমীর মুয়াবিয়া তাকে চিঠে লিখে নিজের পক্ষে যুদ্ধ করার আহ্বান জানালে তিনি তাকে অত্যন্ত কড়া জবাব দেন যে, যেখানে তিনি হযরত আলী (রা.)’র অনুরোধ-ই রাখেন নি, যার জীবনের একটি দিন মুয়াবিয়ার সারা জীবন ও মৃত্যুর চেয়েও অধিক মূল্যবান, সেখানে তিনি মুয়াবিয়ার পক্ষে লড়বেন- এটা সে ভাবল কী করে! হযরত আলী (রা.) সম্পর্কে বিভিন্ন সময়ে হযরত সা’দ যেসব মন্তব্য করেন তাত্থেকে বুঝা যায়, তিনি হযরত আলী (রা.) সম্পর্কে খুবই উচ্চ ধারণা পোষণ করতেন এবং তাঁকে গভীরভাবে শ্রদ্ধা করতেন।


    হযরত সা’দ বিন আবি ওয়াক্কাস (রা.) ৫৫ হিজরিতে সত্তরোর্ধ বয়সে মৃত্যুবরণ করেন; মৃত্যুর সন ও বয়স নিয়ে ভিন্ন ভিন্ন অভিমত রয়েছে। মদীনার তৎকালীন গভর্নর মারওয়ান বিন হাকাম তার জানাযা পড়ান, উম্মুল মুমিনীনগণও তার জানাযায় অংশগ্রহণ করেন। মুহাজির পুরুষদের মধ্যে তিনি সবার শেষে মৃত্যুবরণ করেছিলেন। আর মৃত্যুর পূর্বেই তিনি তার কাফনের জন্য সেই জোব্বাটি ব্যবহার করার ওসীয়্যত করে যান, যা তিনি বদরের যুদ্ধের দিন পরিধান করেছিলেন। এত্থেকে বুঝা যায়, বদরের যুদ্ধে অংশগ্রহণকে সাহাবীরা কতটা মর্যাদার চোখে দেখতেন। হযরত সা’দ (রা.) বিভিন্ন সময়ে নয়টি বিবাহ করেছিলেন এবং তার ১৭জন পুত্র ও ১৭জন কন্যা মোট ৩৪জন সন্তান ছিলেন।


    হযরত সা’দ বিন আবি ওয়াক্কাস (রা.)’র স্মৃতিচারণ শেষ করে হুযূর সম্প্রতি পরলোকগত কয়েকজন নিষ্ঠাবান আহমদীর গায়েবানা জানাযা পড়ানোর ঘোষণা দেন; তারা হলেন মোকাররম সফদর আলী গুজর সাহেব, মোকাররমা ইফফাত নাসীর সাহেবা, মোকাররম আব্দুর রহীম সাকী সাহেব ও মোকাররম সাঈদ আহমদ সায়গল সাহেব। হুযূর মরহুমদের সংক্ষিপ্ত স্মৃতিচারণে তাদের অসাধারণ গুণাবলী ও খিলাফতের প্রতি তাদের নিষ্ঠা, বিশ্বস্ততা, আনুগত্য এবং ইসলাম ও আহমদীয়াতের সেবায় তাদের উজ্জ্বল আদর্শের কথাও তুলে ধরেন। হুযূর তাদের রূহের মাগফিরাত কামনা করেন এবং তাদের পরবর্তী প্রজন্মের মাঝেও যাতে তাদের পুণ্যের ধারা চলমান থাকে সেজন্য দোয়া করেন। (আমীন)

  • পুর্নাঙ্গ অনুবাদ