بِسۡمِ اللّٰہِ الرَّحۡمٰنِ الرَّحِیۡمِِ
২১ আগস্ট, ২০২০
শ্রেষ্ঠ মহাপুরুষ – নিষ্ঠাবান বদরী সাহাবীগণ
মসজিদ মুবারক, ইসলামাবাদ, টিলফোর্ড, লন্ডন
  • সারমর্ম
    এই জুমু’আর খুতবার সারাংশটিতে কোনো প্রকার ত্রুটি-বিচ্যুতি থাকলে তার দায়ভার আহ্‌মদীয়া বাংলা টীম গ্রহণ করছে।

    আহমদীয়া মুসলিম জামা’তের বিশ্ব-প্রধান ও পঞ্চম খলীফাতুল মসীহ্‌ হযরত মির্যা মসরূর আহমদ (আই.) গত ২১শে আগস্ট, ২০২০ ইসলামাবাদের মসজিদে মুবারকে প্রদত্ত জুমুআর খুতবায় পূর্বের ধারা অনুসরণে নিষ্ঠাবান বদরী সাহাবীদের বর্ণাঢ্য জীবনের স্মৃতিচারণ করেন। এ খুতবায় তিনি হযরত যুবায়ের বিন আওয়াম (রা.)’র জীবনের স্মৃতিচারণ করেন।


    তাশাহহুদ, তাআ’ব্বুয ও সূরা ফাতিহা পাঠের পর হুযূর (আই.) বলেন, বদরী সাহাবীদের স্মৃতিচারণের ধারাবাহিকতায় আজ যেই সাহাবীর স্মৃতিচারণ করা হবে তার নাম হযরত যুবায়ের বিন আওয়াম (রা.)। তার পিতার নাম ছিল আওয়াম বিন খুওয়াইলিদ এবং মাতার নাম সাফিয়া বিনতে আব্দুল মুত্তালিব, যিনি মহানবী (সা.)-এর ফুফু ছিলেন। কুসাই বিন ক্বিলাব হযরত যুবায়ের ও মহানবী (সা.)-এর অভিন্ন পূর্বপুরুষ ছিলেন। তিনি উম্মুল মু’মিনীন হযরত খাদিজা (রা.)’র ভাতিজাও ছিলেন। হযরত আবু বকর (রা.)’র কন্যা আসমা বিনতে আবু বকরকে তিনি বিয়ে করেছিলেন; এদিক থেকে তিনি মহানবী (সা.)-এর ভায়রাও ছিলেন। মহানবী (সা.)-এর সাথে তার বিভিন্ন দিক থেকে আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিল। তার ডাকনাম ছিল আব্দুল্লাহ্। তিনি হযরত আবু বকর (রা.)’র পর ইসলাম গ্রহণ করেন, তিনি ইসলাম গ্রহণকারী চতুর্থ বা পঞ্চম ব্যক্তি ছিলেন। ইসলাম গ্রহণের সময় তার বয়স ছিল মাত্র ১২ বছর; অন্যান্য বর্ণনায় ৮ বছর বা ১৬ বছরেরও উল্লেখ পাওয়া যায়। তিনি আশারায়ে মুবাশশারা অর্থাৎ সেই দশজন সাহাবীর একজন ছিলেন, যাদেরকে মহানবী (সা.) তাদের জীবদ্দশায়ই জান্নাতের সুসংবাদ প্রদান করেছিলেন। হযরত উমর (রা.) তার মৃত্যুশয্যায় পরবর্তী খলীফা নির্বাচনের জন্য যে কমিটি গঠন করে যান, হযরত যুবায়ের (রা.)-এর ছয়জন সদস্যের একজন ছিলেন।


    শৈশবে তার পিতা আওয়ামের মৃত্যু হলে তার চাচা নওফেল বিন খুওয়াইলিদ তার অভিভাবকত্ব গ্রহণ করে। হযরত যুবায়ের (রা.)’র মা হযরত সাফিয়া (রা.) তাকে খুব কঠোর শাসনের মধ্য দিয়ে লালন-পালন করতেন, এটি নিয়ে একদিন তার চাচা আপত্তি করে। হযরত সাফিয়া কবিতার ভাষায় তার আপত্তির উত্তর দেন এবং বলেন, আমি এজন্য তার প্রতি কঠোরতা করি যেন সে বড় হয়ে সাহসী ও বীরপুরুষ হয়। প্রাসঙ্গিকভাবে হুযূর (আই.) এ-ও বলেন, তরবীয়তের এই পদ্ধতিটি সঠিক নয়, কেননা এতে শিশুর আত্মবিশ্বাস কমে যায়; তবে যেহেতু মায়ের উদ্দেশ্য মহান ছিল, তাই আল্লাহ্ এর কুপ্রভাব থেকে হযরত যুবায়ের (রা.)-কে রক্ষা করেছেন এবং তিনি বড় হয়ে একজন বীর যোদ্ধা হয়েছিলেন। হযরত যুবায়ের (রা.)’র এই চাচা-ই কিন্তু তার ইসলাম গ্রহণের পর তাকে ইসলাম-বিমুখ করার জন্য চরম অত্যাচার শুরু করে; সে তাকে চাটাইয়ের ভেতর মুড়িয়ে ধোঁয়া দিত যেন তার নিঃশ্বাস বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়। তবুও হযরত যুবায়ের (রা.) স্বীয় ঈমানে অবিচল থাকেন।


    হযরত যুবায়ের (রা.) ইথিওপিয়ার উভয় হিজরতেই অংশগ্রহণ করেছিলেন; মদীনায় হিজরতের পর প্রথমে তিনি হযরত মুনযের বিন মুহাম্মদ (রা.)’র বাড়িতে আশ্রয় নেন। তার স্ত্রী হযরত আসমা (রা.) হিজরতের সময় সন্তানসম্ভবা ছিলেন এবং কুবায় তার পুত্র আব্দুল্লাহ্ বিন যুবায়ের জন্মগ্রহণ করেন, তিনিই ছিলেন মুসলমান ঘরে জন্ম নেয়া প্রথম শিশু। মহানবী (সা.) তাকে কোলে তুলে নিয়ে স্বয়ং খেজুর চিবিয়ে তা তার মুখে দেন এবং তার জন্য কল্যাণের দোয়া করেন। হিজরতের পূর্বে মক্কায় মহানবী (সা.) হযরত যুবায়ের ও হযরত আব্দুল্লাহ্ বিন মাসউদ (রা.)’র মধ্যে ভ্রাতৃত্ব-সম্পর্ক স্থাপন করেছিলেন; মদীনায় হিজরতের পর মহানবী (সা.) আনসার সাহাবী হযরত সালামা বিন সালামা (রা.)-কে তার ধর্মভাই বানান। হযরত যুবায়ের (রা.) বিশিষ্ট শহীদ সাহাবীদের নামানুসারে তার পুত্রদের নাম রেখেছিলেন, যেন তাদের নামের কল্যাণে তার পুত্ররাও শাহাদতের পদমর্যাদা লাভ করেন। হযরত যুবায়ের (রা.) এতটা দীর্ঘকায় ছিলেন যে, যখন তিনি ঘোড়ায় চড়তেন, তখন তার পা মাটিতে গিয়ে ঠেকত। হযরত যুবায়েরের পুত্র উরওয়া একবার তার কাছে জানতে চান, তিনি অন্যান্য বিশিষ্ট সাহাবীদের মত হাদীস বর্ণনা করেন না কেন। উত্তরে তিনি বলেছিলেন, “আমি মহানবী (সা.)-কে একথা বলতে শুনেছি, ‘যে ব্যক্তি জেনে-বুঝে আমার নাম দিয়ে কোন মিথ্যা কথা বর্ণনা করে, সে জাহান্নামে নিজের ঠাঁই করে নেয়।” একথার অর্থ মোটেও এটি নয় যে, যেসব সাহাবী হাদীস বর্ণনা করতেন- তারা মিথ্যা বর্ণনা করতেন; বরং হযরত যুবায়ের খুবই সতর্ক ছিলেন যেন ভুলক্রমেও এরূপ কিছু তার দ্বারা সংঘটিত না হয়।


    হযরত যুবায়ের ইবনুল আওয়াম (রা.) সেই ব্যক্তি যিনি সর্বপ্রথম আল্লাহ্‌র পথে নিজের তরবারী খাপ থেকে উন্মুক্ত করেছিলেন। মক্কায় থাকাকালীন একদিন তিনি কোন এক উপত্যকায় বিশ্রাম নিচ্ছিলেন, হঠাৎ শুনতে পান, কেউ বলছে- মুহাম্মদ (সা.)-কে শহীদ করে দেয়া হয়েছে। একথা শোনামাত্রই তিনি উন্মুক্ত তরবারী নিয়ে ঘর থেকে বের হন। পথিমধ্যে মহানবী (সা.)-এর সাথে দেখা হয়ে যায়। মহানবী (সা.) তার কাছে সব বৃত্তান্ত শুনে প্রশ্ন করেন, সত্যিই যদি এমনটি হতো তাহলে তিনি কী করতেন। যুবায়ের (রা.) উত্তরে বলেন, ‘আল্লাহ্‌র কসম! আমি সকল মক্কাবাসীকে হত্যা করার সংকল্প করেছিলাম।’ মহানবী (সা.) তার এই আবেগ ও স্পৃহা দেখে তার জন্য বিশেষ দোয়া করেন। হযরত যুবায়ের (রা.) বদর ও উহুদসহ সকল যুদ্ধেই মহানবী (সা.)-এর সহযোদ্ধা হিসেবে অংশগ্রহণ করেছিলেন। উহুদের যুদ্ধের দিন সংকটময় মুহূর্তে যে স্বল্পসংখ্যক সাহাবী মহানবী (সা.)-এর সাথে দৃঢ়-অবিচল ছিলেন, হযরত যুবায়ের (রা.) ছিলেন তাদের অন্যতম; তিনি তখন মৃত্যুর শর্তেও বয়আত করেছিলেন। মক্কা-বিজয়ের দিন মুহাজিরদের তিনটি পতাকার একটি তার হাতে ছিল। তার পুত্র উরওয়া বর্ণনা করেন, হযরত যুবায়ের (রা.)’র দেহে তিনটি গভীর ক্ষতচিহ্ন ছিল; দু’টি বদরের যুদ্ধে পাওয়া আঘাতের ও একটি ইয়ারমুকের যুদ্ধে পাওয়া আঘাতের ক্ষতচিহ্ন। তিনি যুদ্ধক্ষেত্রে সাধারণতঃ হলুদ পাগড়ি পরতেন; বদরের যুদ্ধের দিনও তা-ই পরেছিলেন। মহানবী (সা.) বলেছিলেন, ফিরিশ্তারাও তার মতই হলুদ পাগড়ি পরে যুদ্ধক্ষেত্রে অবতীর্ণ হয়েছে।


    হযরত যুবায়ের (রা.) বর্ণনা করেন, উহুদের যুদ্ধের দিন একজন নারীকে দ্রুতবেগে শহীদদের লাশের দিকে যেতে দেখে মহানবী (সা.) তাকে বাধা দিতে বলেন; তিনি ছিলেন যুবায়েরের মা হযরত সাফিয়া। হযরত যুবায়ের দ্রুত ছুটে গিয়ে মা-কে বাধা দিতে গেলে হযরত সাফিয়া তাকে জোরে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দেন; কিন্তু যখন তাকে বলা হয় এটি মহানবী (সা.)-এর নির্দেশ, তখন তিনি নিরস্ত হন। অপর এক বর্ণনামতে হযরত সাফিয়া ওয়াদা করেন যে, তিনি ধৈর্য ধরবেন, তাকে যেন তার ভাই হযরত হামযার লাশ দেখতে দেয়া হয়। মহানবী (সা.) ধৈর্য ধরার শর্তে তাকে হযরত হামযার লাশ দেখতে দেন। পরিখার যুদ্ধের সময় একদিন মহানবী (সা.) বারবার বলছিলেন, ‘আমাকে বনু কুরায়যার খবর এনে দেয়ার কেউ আছে কি?’ মহানবী (সা.) তিনবার এই প্রশ্ন করেন; তিনবারই হযরত যুবায়ের (রা.) সাড়া দেন যে, তিনি এই সেবার জন্য প্রস্তুত। তখন মহানবী (সা.) বলেছিলেন, ‘প্রত্যেক নবীর-ই হাওয়ারী থাকেন, আমার হাওয়ারী হল যুবায়ের।’


    খায়বারের যুদ্ধে হযরত মুহাম্মদ বিন মাসলামা (রা.) বিখ্যাত ইহুদী নেতা মারহাবকে হত্যা করেন। এতে তার ভাই ইয়াসের এসে তার সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার প্রকাশ্য চ্যালেঞ্জ দিলে হযরত যুবায়ের (রা.) এগিয়ে যান। তখন তার মা হযরত সাফিয়া এসে মহানবী (সা.)-এর কাছে নিবেদন করেন, আজ হয়তো যুবায়ের শাহাদত লাভ করতে চলেছে। মহানবী (সা.) বলেন- না, বরং তার হাতে ইয়াসের নিহত হবে; বাস্তবেও তা-ই হয়েছিল। হুনায়নের যুদ্ধের দিনও হযরত যুবায়ের (রা.) অসাধারণ বীরত্ব প্রদর্শন করেছিলেন এবং কাফির নেতা মালেক বিন অওফ ও তার সঙ্গী-সাথীদের একটি গিরিপথ থেকে পালাতে বাধ্য করেছিলেন। ইয়ারমুকের যুদ্ধে মহানবী (সা.)-এর সাহাবীদের অনুরোধে হযরত যুবায়ের শত্রুদের ওপর প্রবলবেগে আক্রমণ করে শত্রুব্যূহ ভেদ করে বেরিয়ে যান এবং পেছন ফিরে দেখতে পান যে, আর কেউ-ই তার সাথে গতি বজায় রাখতে পারেন নি, আর তিনি একাই শত্রুদের মধ্যে ঢুকে পড়েছেন। তিনি যখন ফিরে আসতে যান, তখন কাফিররা তার ঘোড়ার লাগাম ধরে ফেলে এবং আক্রমণ করে তার কাঁধে দু’টি আঘাত হানে, যার মধ্যে একটি সেই পুরোন ক্ষতটির ওপরে লেগেছিল যেটি বদরের যুদ্ধের দিন তার কাঁধে সৃষ্টি হয়েছিল। সিরিয়া বিজয়ের পর যখন হযরত আমর বিন আস আলেকজান্দ্রিয়া আক্রমণের সংকল্প করেন, তখন তিনি হযরত উমর (রা.)’র কাছে আরও সেনা প্রেরণের জন্য লিখেন। হযরত উমর (রা.) দশ হাজার সৈন্য ও চারজন সেনাপতি পাঠান এবং বলেন, এই চারজনের প্রত্যেকেই এক হাজার সৈন্যের সমান; তাদের একজন ছিলেন হযরত যুবায়ের (রা.)। হযরত যুবায়েরের মাধ্যমেই খ্রিস্টানদের দুর্গগুলোর পতন ঘটে। হযরত উমর (রা.)’র মৃত্যুর পর খিলাফত কমিটির মাধ্যমে পরবর্তী খলীফার নির্বাচনের ঘটনাও হুযূর (আই.) তুলে ধরেন। হুযূর বলেন, হযরত যুবায়ের (রা.)’র স্মৃতিচারণ আগামী খুতবাতেও চলমান থাকবে (ইনশাআল্লাহ্)।


    খুতবার শেষদিকে হুযূর সম্প্রতি পরলোকগত তিনজন নিষ্ঠাবান আহমদীর গায়েবানা জানাযা পড়ানোর ঘোষণা দেন ও তাদের সংক্ষিপ্ত স্মৃতিচারণ করেন। তাদের মধ্যে প্রথম হলেন, পেশোয়ার-নিবাসী শ্রদ্ধেয় মাহমুদ আহমদ সাহেবের পুত্র শহীদ মিরাজ আহমদ সাহেব, যাকে গত ১২ই আগস্ট রাত ৯টায় অজ্ঞাত পরিচয় বন্দুকধারীরা তার মেডিকেল স্টোরের সামনে গুলি করে শহীদ করে (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। প্রসঙ্গতঃ হুযূর বলেন, পাকিস্তানে আজকাল আহমদীয়াতের বিরোধিতা খুব তীব্র আকার ধারণ করেছে; হুযূর (আই.) জামাতের সদস্যদেরকে অনেক বেশি পরিমাণে দরূদ শরীফ, ‘রাব্বি কুল্লু শাইয়িন খাদিমুকা- রাব্বি ফাহ্ফাযনি ওয়ানসুরনি ওয়ারহামনি’ এবং ‘আল্লাহুম্মা ইন্না নাজআলুকা ফি নুহূরিহিম ওয়া নাউ’যুবিকা মিন শুরূরিহিম’ দোয়া দু’টো পড়ার আহ্বান জানান। দ্বিতীয় জানাযা নারওয়াল-নিবাসী মুহাম্মদ নাসের আহমদ ডোগর সাহেবের পুত্র মুরব্বী সিলসিলাহ্ আদীব আহমদ নাসের সাহেবের, যিনি গত ৯ই আগস্ট অল্প কিছুদিন অসুস্থ থাকার পর মাত্র ২৭ বছর বয়সে ইন্তেকাল করেন; তৃতীয় জানাযা শেখ মুহাম্মদ হুসেন সাহেবের পুত্র শ্রদ্ধেয় হামীদ আহমদ শেখ সাহেবের, যিনি গত ১২ই আগস্ট হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে ৮৫ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন। হুযূর (আই.) তাদের প্রত্যেকের রূহের মাগফিরাত কামনা করেন ও জান্নাতে তাদের পদমর্যাদা উন্নীত হওয়ার জন্য আর তাদের শোকসন্তপ্ত পরিবারের জন্য দোয়া করেন। (আমীন)

  • পুর্নাঙ্গ অনুবাদ