بِسۡمِ اللّٰہِ الرَّحۡمٰنِ الرَّحِیۡمِِ
১১ সেপ্টেম্বর, ২০২০
শ্রেষ্ঠ মহাপুরুষ – নিষ্ঠাবান বদরী সাহাবীগণ
মসজিদ মুবারক, ইসলামাবাদ, টিলফোর্ড, লন্ডন
  • সারমর্ম
    এই জুমু’আর খুতবার সারাংশটিতে কোনো প্রকার ত্রুটি-বিচ্যুতি থাকলে তার দায়ভার আহ্‌মদীয়া বাংলা টীম গ্রহণ করছে।

    আহমদীয়া মুসলিম জামা’তের বিশ্ব-প্রধান ও পঞ্চম খলীফাতুল মসীহ্‌ হযরত মির্যা মসরূর আহমদ (আই.) গত ১১ই সেপ্টেম্বর, ২০২০ ইসলামাবাদের মসজিদে মুবারকে প্রদত্ত জুমুআর খুতবায় পূর্বের ধারা অনুসরণে নিষ্ঠাবান বদরী সাহাবীদের বর্ণাঢ্য জীবনের স্মৃতিচারণ করেন। এ খুতবায় তিনি হযরত বিলাল (রা.)’র জীবনের স্মৃতিচারণ করেন।


    তাশাহহুদ, তাআ’ব্বুয ও সূরা ফাতিহা পাঠের পর হুযূর (আই.) বলেন, আজ আমি যে বদরী সাহাবীর স্মৃতিচারণ করব তার নাম হযরত বিলাল বিন রাবাহ্ (রা.)। তার পিতার নাম ছিল রাবাহ্ এবং মায়ের নাম হামামাহ্; হযরত বিলাল উমাইয়া বিন খালফের ক্রীতদাস ছিলেন। তার ডাকনাম ছিল আবু আব্দুল্লাহ্; অপর কতক বর্ণনায় আবু আব্দুর রহমান এবং আবু আমর প্রভৃতি নামেরও উল্লেখ পাওয়া যায়। তার মা ছিলেন আবিসিনিয়ান, কিন্তু পিতা আরবেরই বাসিন্দা ছিলেন। গবেষকদের মতে তিনি সেমিটিক আবিসিনিয়ান ছিলেন, অর্থাৎ প্রাচীনকালে তাদের পূর্বপুরুষরা আরব থেকে আফ্রিকায় গিয়ে বসবাস শুরু করে; এর ফলে তাদের বর্ণ তো অন্যান্য আফ্রিকানদের মত হয়ে যায়, কিন্তু স্বভাব ও বৈশিষ্ট্যে তারা আফ্রিকানদের মত ছিল না। পরবর্তীতে তাদের কতককে ক্রীতদাস হিসেবে আরবে নিয়ে আসা হয়; তাদের গায়ের রং যেহেতু কৃষ্ণকায় ছিল, তাই আরবরা তাদেরকে আবিসিনিয়ান বলত। এক বর্ণনামতে হযরত বিলাল (রা.) মক্কাতেই জন্মগ্রহণ করেন; আরেক বর্ণনামতে তিনি সুরাহ্ নামক স্থানে জন্মগ্রহণ করেন যা ইয়েমেন ও আবিসিনিয়ার নিকটবর্তী একটি স্থান, যেখানে প্রচুর মিশ্র-জাতির মানুষের বসবাস ছিল। হযরত বিলালের গায়ের রং ছিল গাঢ় বা কালচে বাদামী; তিনি ছিপছিপে গড়নের ছিলেন, মাথার চুল ঘন ও চাপা ছিল ভাঙ্গা। তিনি একাধিক বিবাহ করেছিলেন বলে জানা যায়। তার স্ত্রীদের কেউ কেউ আরবের অত্যন্ত সম্ভ্রান্ত বংশের নারী ছিলেন; হযরত আব্দুর রহমান বিন অওফের বোন হালাহ্ বিনতে অওফ তার অন্যতম সহধর্মিনী ছিলেন। হযরত বিলাল (রা.) নিঃসন্তান ছিলেন; খালেদ নামে তার একজন ভাই এবং গুফায়রা নামে একজন বোন ছিল।


    হযরত বিলাল (রা.) আবিসিনিয়ানদের মধ্যে প্রথম মুসলমান ছিলেন। মহানবী (সা.) বলতেন, ‘মুসলমানদের মধ্যে চারজন ব্যক্তি প্রথম; আরবদের মধ্যে প্রথম হলাম আমি, সালমান পারস্যবাসীদের মধ্যে প্রথম, বিলাল আবিসিনিয়ানদের মধ্যে প্রথম, সুহায়েব রোমানদের মধ্যে প্রথম ইসলাম গ্রহণ করেন।’ উরওয়া বিন যুবায়ের (রা.) বর্ণনা করেন, হযরত বিলাল (রা.) সেসব লোকের অন্যতম ছিলেন যাদেরকে ইসলাম গ্রহণ করার কারণে নিষ্ঠুর অত্যাচার সইতে হয়, যেন তারা এই ধর্ম পরিত্যাগ করেন; কিন্তু অত্যাচারীরা কখনোই তাকে দিয়ে সেসব কথা বলাতে পারে নি যা তারা চাইত। উমাইয়া বিন খালফ তাকে চরম অত্যাচার করত; মরুভূমির তপ্ত বালুর ওপর নগ্ন করে শুইয়ে তার বুকের ওপর পাথর চাপিয়ে দিত, কখনওবা এই অবস্থায় বাউণ্ডুলে ছেলেরা তার ওপর জুতো পায়ে নৃত্য করতো, কখনও তার গলায় দড়ি বেঁধে পাথুরে মাটির ওপর দিয়ে টেনেহেঁচড়ে নিয়ে যেত; কিন্তু তিনি সবসময় ‘আহাদ-আহাদ’ অর্থাৎ ‘আল্লাহ্ এক- আল্লাহ্ এক’ বলতে থাকতেন। এভাবে একদিন যখন তার ওপর প্রচণ্ড অত্যাচার করা হচ্ছিল, তখন হযরত আবু বকর (রা.) ৭ অওকিয়া বা স্বর্ণমুদ্রা দিয়ে তাকে ক্রয় করে নেন। হযরত আবু বকর যখন তাকে কিনে নেন তখন হযরত বেলাল (রা.) পাথরের স্তুপের নীচে মৃতবৎ অবস্থায় পড়ে ছিলেন; কাফিররা আবু বকর (রা.)-কে বলেছিল, ‘তুমি চাইলে তো একে এক স্বর্ণমুদ্রা দিয়েই কিনতে পারতে!’ জবাবে হযরত আবু বকর বলেছিলেন, ‘তোমরা যদি একশ’ স্বর্ণমুদ্রাও চাইতে, তবে আমি তা দিয়েই তাকে কিনে নিতে প্রস্তুত ছিলাম!’ যখন তিনি মহানবী (সা.)-কে এটি জানান তখন হুযূর (সা.) বলেন, ‘হে আবু বকর, আমাকেও এতে অংশীদার কর।’ হযরত আবু বকর (রা.) বলেন, ‘হে আল্লাহ্‌র রসূল, আমি তো তাকে মুক্ত করে দিয়েছি! এটি শুনে হুযূর (সা.) খুবই আনন্দিত হন। হযরত উমর (রা.) বলতেন, ‘আবু বকর আমাদের নেতা; আর তিনি আমাদের নেতা বিলালকে মুক্ত করেছিলেন।’ হযরত আবু বকর (রা.) এভাবে আরো অনেক ক্রীতদাসকে ক্রয় করে মুক্ত করেছিলেন বলে ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়।


    হযরত আব্দুল্লাহ্ বিন মাসঊদ (রা.) বর্ণনা করেন, সর্বপ্রথম সাতজন নিজেদের ইসলাম গ্রহণের কথা প্রকাশ্যে ঘোষণা করেন; রসূলুল্লাহ্ (সা.) স্বয়ং, হযরত আবু বকর, হযরত আম্মার ও তার মা হযরত সুমাইয়া, হযরত সুহায়েব, হযরত বিলাল ও হযরত মিকদাদ রাযিআল্লাহু আনহহুম। রসূলুল্লাহ্ (সা.) ও হযরত আবু বকর তো স্বাধীন ব্যক্তি ছিলেন, তা সত্ত্বেও তাদেরকে ভয়াবহ অত্যাচার সইতে হয়েছে; আর বাকি পাঁচজন ক্রীতদাস হওয়ায় মুশরিকরা তাদের উপর চড়াও হয় এবং অবর্ণনীয় অত্যাচার চালায়। আব্দুল্লাহ্ বিন মাসঊদ (রা.) বলেন, তাদের মধ্যে একজন ছাড়া অন্য সবাই অত্যাচারের কোন এক পর্যায়ে মুশরিকদের কথায় সায় দিয়ে ফেলেছিলেন; আর সেই একজন হলেন হযরত বিলাল (রা.), যাকে দিয়ে কখনোই কোন অসঙ্গত কথা তারা বলাতে পারে নি। কাফিরদের প্রচণ্ড অত্যাচারের ফলে হযরত বিলাল ‘শিন’ বর্ণটি আর উচ্চারণ করতে পারতেন না, এটিকে ‘সিন’ উচ্চারণ করতেন। মদীনায় যখন মুসলমানরা কিছুটা স্বাধীনভাবে ইবাদত পালনে সমর্থ হয়, তখন মহানবী (সা.) হযরত বিলাল (রা.)-কে আযান দেয়ার দায়িত্ব প্রদান করেন। তিনি ‘আশহাদু’র পরিবর্তে ‘আসহাদু’ উচ্চারণ করতেন, মদীনায় যারা তার অতীত জানত না তারা এটি শুনে হাসাহাসি করত। মহানবী (সা.) একদা তাদেরকে হাসাহাসি করতে দেখে বলেন, ‘তোমরা বিলালের আযান শুনে হাসছ? অথচ আল্লাহ্ তা’লা আরশ থেকে তার আযান শুনে আনন্দিত হন!’ তিনি (সা.) বুঝাতে চেয়েছিলেন, আযানের উচ্চারণে কি-ইবা আসে যায়, আসল ব্যাপার তো হল আল্লাহ্‌র একত্ববাদের জন্য তার আত্মত্যাগ; তার কুরবানির কারণে আল্লাহ্ তা’লা তার ভুল উচ্চারণের আযান শুনেও আনন্দিত হন। হযরত বিলাল (রা.) ‘আসসাবেকুনাল আওয়ালুন’দের মধ্যে পরিগণিত হতেন। মহানবী (সা.) বলতেন, ‘আমার প্রতি প্রথম ঈমান এনেছিল একজন ক্রীতদাস ও একজন স্বাধীন ব্যক্তি’; কারও কারও মতে এই ক্রীতদাস ছিলেন হযরত বিলাল, কারও মতে তিনি ছিলেন হযরত খাব্বাব (রা.); আর স্বাধীন ব্যক্তি যে হযরত আবু বকর ছিলেন- তা তো সবারই জানা।


    হযরত বিলাল (রা.) হিজরতের পর মদীনায় এসে প্রথমে হযরত সা’দ বিন খায়সামার বাড়িতে ওঠেন। মহানবী (সা.) হযরত উবায়দা বিন হারেস (রা.)’র সাথে তার ভ্রাতৃত্ব বন্ধন প্রতিষ্ঠা করেন; অপর এক বর্ণনামতে তার ধর্মভাই ছিলেন হযরত আবু রুওয়াইহা খাসামি। মদীনায় হিজরতের পর অনেক সাহাবীই অসুস্থ হয়ে পড়েন; তারা জ্বরের ঘোরে প্রলাপ বকতেন। হযরত বিলাল (রা.) অত্যন্ত করুণ সুরে কবিতা আবৃত্তি করতেন এবং জন্মভূমি মক্কার জন্য কাঁদতেন; আরও কয়েকজন সাহাবীও এরূপ করতেন। মহানবী (সা.) তাদের এই করুণ অবস্থা দেখে তাদের মনে মদীনার প্রতি ভালোবাসা সৃষ্টি করে দেওয়ার জন্য আল্লাহ্‌র কাছে দোয়া করেন এবং মদীনার অসুখ-বিসুখ দূর করে এর আবহাওয়া স্বাস্থ্যকর বানিয়ে দেওয়ার দোয়া করেন; এরপর তাঁর (সা.) দোয়া আল্লাহ্ কবুল করেন।


    হযরত বিলাল (রা.) বদর, উহুদ, খন্দকসহ সকল যুদ্ধেই মহানবী (সা.)-এর সাথে অংশগ্রহণ করেছেন; বদরের যুদ্ধে তিনি উমাইয়া বিন খালফকে হত্যা করেন, যে ইসলামের অনেক বড় শত্রু ছিল। হযরত বিলাল (রা.) মহানবী (সা.)-এর ব্যক্তিগত সচিবের মত ছিলেন এবং তাঁর (সা.) কোষাধ্যক্ষও ছিলেন। তিনি রসূলুল্লাহ্ (সা.)-এর মুয়ায্যিনও ছিলেন; তিনি-ই সেই প্রথম ব্যক্তি যিনি আযান দেন। প্রাসঙ্গিকভাবে হুযূর (আই.) আযানের ইতিহাসও তুলে ধরেন যে কীভাবে হযরত আব্দুল্লাহ্ বিন যায়েদ (রা.)-কে স্বপ্নে আযানের বাক্যগুলো শেখানো হয়েছিল এবং হযরত উমর (রা.)-ও একই স্বপ্ন দেখেছেন বলে ঘোষণা দিয়েছিলেন; ফজরের আযানের ‘আসসালাতু খাইরুম্ মিনান্নাওম’ বাক্যটি হযরত বিলাল (রা.)’র প্রস্তাবিত যা মহানবী (সা.) তাকে ফজরের আযানে যুক্ত করতে নির্দেশ দেন। হুযূর (আই.) বলেন, হযরত বিলাল (রা.)’র স্মৃতিচারণ কিছুটা বাকি রয়েছে যা আগামীতে করা হবে, (ইনশাআল্লাহ্)।


    সাহাবীর স্মৃতিচারণ শেষে হুযূর কয়েকটি গায়েবানা জানাযা পড়ানোর ঘোষণা দেন। প্রথম জানাযা বেলজিয়াম-প্রবাসী বাঙ্গালি স্নেহের রউফ বিন মাকসুদ জুনিয়রের, যে জামেয়া আহমদীয়া যুক্তরাজ্যের ছাত্র ছিল; গত ৪ঠা সেপ্টেম্বর মাত্র ১৮ বছর বয়সে পরম করুণাময় আল্লাহ্‌র সান্নিধ্যে যাত্রা করে (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। মরহুম ২০১৮-তে জামেয়ায় ভর্তি হয়েছিল। হুযূর বলেন, স্নেহের রউফ তার নিষ্ঠা, সৃষ্টিসেবার স্পৃহা ও পরিশ্রমী বৈশিষ্ট্যের কারণে ছাত্র-শিক্ষক সবার প্রিয়পাত্র ছিল; ছয়-সাত মাস পূর্বে তার ব্রেন টিউমার ধরা পড়ে, পরম ধৈর্যের সাথে সে সব কষ্ট সহ্য করেছে। মরহুম শোকসন্তপ্ত পরিবারে পিতা হুমায়ূন মাকসুদ সাহেব ও মা মুহসেনা বেগম সাহেবা ছাড়াও তিন ভাই ও দু’বোন রেখে গিয়েছে। বেলজিয়ামের মুরব্বী সাহেব লিখেছেন, করোনা মহামারীর শুরুর দিকে তিনি রউফকে অনলাইনে আতফালদের ক্লাস নিতে বলেন; এর মধ্যেই সে অসুস্থ হয়ে পড়ে। কিন্তু রউফ অসুস্থ অবস্থাতেও হাসপাতাল থেকেই অনলাইনে ক্লাস নিত আর কোন কোন সময় ক্লাস চলাকালীনই অচেতন হয়ে পড়তো। তার অসুখের ভয়াবহতা বিবেচনা করে যখন তাকে অব্যাহতি নেয়ার জন্য অনুরোধ করা হয়, তখন সে বলেছিল, ‘যখন করোনার পর জামেয়া খুলবে, তখন আমি গিয়ে হুযূরকে কী জবাব দেব যে, ছুটির মধ্যে আমি জামাতের কী সেবা করেছি?’ সে হাসপাতালে ডাক্তারদেরও তবলীগ করতো। হুযূর বলেন, জামেয়া পাস করার আগেই সে উত্তম মুরব্বী ও মুবাল্লিগ হয়ে গিয়েছিল। তার সম্পর্কে অনেকেই অসংখ্য স্মৃতিচারণ করেছেন, যেগুলো থেকে জামাত ও খিলাফতের প্রতি তার গভীর ভালোবাসা, নিষ্ঠা, ধর্মসেবার প্রবল আগ্রহ এবং মহান আল্লাহ্‌র ইবাদতের প্রতি গভীর মনোযোগ ও নিমগ্নতা; ছোট-বড়, বন্ধু-বান্ধব, চেনা-অচেনা সবার প্রতি শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার অসাধারণ চিত্র ফুটে ওঠে। হুযূর বলেন, আল্লাহ্ তা’লাই নিজের সিদ্ধান্তের প্রজ্ঞা ও রহস্য ভাল জানেন; অনেক সময় তিনি সবচেয়ে উত্তম বান্দাদের দ্রুত নিজের কাছে ডেকে নেন। হুযূর (আই.) তার রূহের মাগফিরাত কামনা করেন এবং দোয়া করেন, আল্লাহ্ যেন তার নিকটজনদের ধৈর্য দান করেন।


    দ্বিতীয় জানাযা ইসলামাবাদের সাবেক জেলা নায়েবে আমীর জাফর ইকবাল কুরাইশী সাহেবের, তৃতীয় জানাযা সেনেগালের সাবেক সংসদ-সদস্য মোহতরম কাবিনে-কাবাজাকাটে সাহেবের ও চতুর্থ জানাযা লাহোরের মোকাররম ব্যারিস্টার মোবাশ্বের লতিফ সাহেবের; হুযূর তাদেরও সংক্ষিপ্ত স্মৃতিচারণ করেন ও তাদের রূহের মাগফিরাত কামনা করে দোয়া করেন এবং নামাযান্তে তাদের সবার গায়েবানা জানাযা পড়ান।

  • পুর্নাঙ্গ অনুবাদ