সারমর্ম
এই জুমু’আর খুতবার সারাংশটিতে কোনো প্রকার ত্রুটি-বিচ্যুতি থাকলে তার দায়ভার আহ্মদীয়া বাংলা টীম গ্রহণ করছে।
আহমদীয়া মুসলিম জামা’তের বিশ্ব-প্রধান ও পঞ্চম খলীফাতুল মসীহ্ হযরত মির্যা মসরূর আহমদ (আই.) গত ১৮ই সেপ্টেম্বর, ২০২০ ইসলামাবাদের মসজিদে মুবারকে প্রদত্ত জুমুআর খুতবায় পূর্বের ধারা অনুসরণে নিষ্ঠাবান বদরী সাহাবীদের বর্ণাঢ্য জীবনের স্মৃতিচারণ করেন। এ খুতবায়ও তিনি হযরত বিলাল (রা.)’র জীবনের স্মৃতিচারণ বজায় রাখেন।
তাশাহহুদ, তাআ’ব্বুয ও সূরা ফাতিহা পাঠের পর হুযূর (আই.) বলেন, গত শুক্রবার বদরী সাহাবী হযরত বিলাল (রা.)-এর স্মৃতিচারণ করা হচ্ছিল, আজ তার অবশিষ্টাংশ বর্ণনা করব। হযরত আবু হুরায়রা (রা.) বর্ণনা করেন, খায়বারের যুদ্ধ থেকে ফেরার সময় মহানবী (সা.) রাতের বেলাও সফর অব্যাহত রাখেন; যখন একেবারে শ্রান্ত-ক্লান্ত হয়ে পড়েন তখন যাত্রা-বিরতি করেন এবং হযরত বিলাল (রা.)-কে বলেন, ‘আজ রাতে নামাযের সময়ের সুরক্ষা তুমি করবে;’ অর্থাৎ তাকে ফজরের সময় জাগানোর দায়িত্ব প্রদান করেন। হযরত বিলাল (রা.) রাত জেগে নফল নামায পড়তে থাকেন, কিন্তু ফজরের সময়ের সামান্য পূর্বে ক্লান্তিতে তিনি নিজ বাহনের গায়ে হেলান দিয়েই ঘুমিয়ে পড়েন; ক্লান্তির কারণে সেদিন সময়মত কারোই ঘুম আর ভাঙেনি। সূর্যোদয়ের পর সূর্যের আলোয় সর্বপ্রথম মহানবী (সা.)-এর ঘুম ভাঙে। হুযূর (সা.) হযরত বিলালের নাম ধরে ডাকতে থাকেন; হযরত বিলাল (রা.) ঘুম ভেঙে ছুটে আসেন ও পুরো ব্যাপার খুলে বলেন। মহানবী (সা.) যাত্রা শুরু করেন এবং কিছুদূর অগ্রসর হয়ে থামেন ও নামাযের জন্য প্রস্তুত হয়ে সবাইকে নিয়ে বাজামাত নামায পড়েন। নামাযান্তে মহানবী (সা.) বলেন, “কেউ যদি নামায পড়তে ভুলে যায়, তাহলে তার উচিত- যখনই তার মনে পড়ে, সে যেন তখনই নামায পড়ে নেয়; কেননা আল্লাহ্ তা’লা বলেছেন: ‘আমাকে স্মরণ করার জন্য নামায কায়েম কর’।”
মহানবী (সা.) মক্কা-বিজয়ের দিন যখন কা’বা ঘরের ভেতর প্রবেশ করেন, তখন তাঁর সাথে হযরত বিলাল, উসামা বিন যায়েদ ও উসমান বিন তালহা রাযিআল্লাহু আনহুমও ছিলেন; ভেতরে ঢুকে তারা দরজা বন্ধ করে দেন। তারা বের হলে হযরত আব্দুল্লাহ্ ইবনে উমর, হযরত বিলালের কাছে ছুটে গিয়ে জানতে চান, মহানবী (সা.) কা’বা ঘরের ভেতরে নামায পড়েছেন কি-না? উত্তরে হযরত বিলাল (রা.) বলেন, তিনি (সা.) কা’বা গৃহের অভ্যন্তরে দুই স্তম্ভের মধ্যখানে দাঁড়িয়ে নামায পড়েছেন। সেদিন হুযূর (সা.)-এর নির্দেশে হযরত বিলাল (রা.) কা’বা শরীফের ছাদে উঠে আযান দিয়েছিলেন। মক্কা সেই নগরী, যেখানে হযরত বিলাল (রা.)-কে একসময় চরম অত্যাচার, অপমান ও লাঞ্ছনার শিকার হতে হয়েছিল। মক্কা-বিজয়ের দিন মহানবী (সা.) আশ্চর্যজনকভাবে মধুর উপায়ে তার প্রতিশোধ নিয়েছিলেন। মুসলিম বাহিনী মক্কায় প্রবেশের পূর্বেই আবু সুফিয়ান যখন ইসলাম গ্রহণ করে, তখন একইসাথে মক্কাবাসীর নিরাপত্তার জন্যও তিনি মহানবী (সা.)-এর কাছে আবেদন জানায়। হুযূর (সা.) বেশ কয়েকটি সুযোগ দেন; তিনি (সা.) বলেন, যারা আবু সুফিয়ানের বাড়িতে আশ্রয় নিবে কিংবা কা’বার চত্বরে সমবেত হবে, অথবা অস্ত্র সমর্পণ করবে বা নিজের বাড়িতে ঢুকে দরজা বন্ধ করে রাখবে- তাদের কাউকেই কিছু করা হবে না। আবু সুফিয়ান বলে, তবুও তো অনেকের জন্য শংকা থেকে যাবে। তখন মহানবী (সা.) হযরত বিলালের ধর্মভাই আনসারী সাহাবী আবু রুওয়াইহাকে ডেকে তার হাতে একটি পতাকা তুলে দেন এবং মক্কায় প্রবেশের সময় এই ঘোষণা করতে বলেন- ‘এটা বিলালের পতাকা; যে এর নিচে আশ্রয় নেবে, সে নিরাপদ থাকবে।’ বস্তুতঃ যখন মুসলিম বাহিনী মক্কায় প্রবেশ করে তখন কুরাইশদের অনেকেই নিরাপত্তার জন্য হযরত বিলাল (রা.)’র পতাকাতলে এসে আশ্রয় নেয়। মহানবী (সা.) ও মুহাজিরগণ যদিও একসময় মক্কাবাসীদের নৃশংস অত্যাচারের সম্মুখীন হয়েছিলেন, কিন্তু তবুও তারা তাদের রক্ত-সম্পর্কের আত্মীয়ই ছিল; একমাত্র হযরত বিলাল-ই সেই ব্যক্তি ছিলেন, যার মক্কায় কোন আত্মীয়-স্বজন ছিল না। এ কারণে তাদেরকে ক্ষমা করলে হয়তো হযরত বিলাল (রা.)’র মনের কোণে একটা দুঃখ থেকে যেত যে ‘মহানবী (সা.) তাঁর জ্ঞাতি-ভাইদের ক্ষমা করে দিলেন, অথচ আমার অপমানের প্রতিশোধ নেয়া হল না?’ কিন্তু মহানবী (সা.) এত মধুর উপায়ে প্রতিশোধ নিলেন যে, একদিন যারা জুতো পরে বিলালের বুকের ওপর চড়ে নৃত্য করতো, তারাই আজ নিজেদের প্রাণ রক্ষার্থে যেন বিলালের পদতলে এসে ঠাঁই নিচ্ছে। তাদের হত্যা করলেও হযরত বিলালের পক্ষে এমন চরম প্রতিশোধ নেয়া সম্ভব ছিল না! মহানবী (সা.) পৃথিবীকে দেখিয়ে দিলেন, রক্তপাত না ঘটিয়েই ইসলাম কত সুন্দর ও মধুরভাবে প্রতিশোধ নিতে পারে।
প্রসঙ্গক্রমে হুযূর (আই.) আরও একটি বিষয় স্পষ্ট করেন; হযরত মুসলেহ্ মওউদ (রা.) এই ঘটনাটিকে তার বিভিন্ন রচনায় ভিন্ন ভিন্ন আঙ্গিকে বর্ণনা করেছেন। কেউ কেউ আপত্তি করে বসে যে, ‘অমুক স্থানে তো বর্ণনা এমন ছিল, এখানে এমন কেন?’ ইত্যাদি। বস্তুতঃ বর্ণনা একটিই, কিন্তু কোথাও তা কিছুটা বিস্তারিত, কোথাও সংক্ষিপ্ত; কিন্তু মূল বিষয়বস্তু একই। আলোচনার প্রেক্ষাপটের ভিন্নতার কারণে একেক স্থানে একেকটি বিষয়ের ওপর আলোকপাতে কম-বেশি হয়ে থাকে।
মহানবী (সা.) যখন ঈদের দিন নামাযের জন্য ঈদগাহে যেতেন, তখন একজন তাঁর (সা.) বর্শাটি হাতে নিয়ে সামনে সামনে এগোত; অধিকাংশ ক্ষেত্রে এই দায়িত্ব পালন করতেন হযরত বিলাল (রা.)। মহানবী (সা.)-এর তিরোধানের পর হযরত বিলাল (রা.) হযরত আবু বকর (রা.)’র জন্যও এভাবে যেতেন। মহানবী (সা.)-এর তিরোধানের পর হযরত বিলাল (রা.) হযরত আবু বকর (রা.)’র কাছে এসে জিহাদে যাওয়ার অনুমতি চেয়েছিলেন; কারণ মহানবী (সা.) তাকে বলেছিলেন, ‘হে বিলাল! আল্লাহ্র পথে জিহাদের চেয়ে উত্তম আর কোন ইবাদত নেই।’ হযরত আবু বকর (রা.) আল্লাহ্র দোহাই দিয়ে তাকে থাকতে বলেন এবং বলেন, ‘আমি বুড়ো ও দুর্বল হয়ে গিয়েছি, আমার মৃত্যুও সন্নিকট; তুমি আমার কাছে থাক!’ হযরত আবু বকর (রা.)’র অনুরোধে বিলাল (রা.) মদীনায় থেকে যান। কিন্তু তার তিরোধানের পর হযরত উমর (রা.) খলীফা নির্বাচিত হলে তিনি তার কাছে এসেও একই নিবেদন জানান; হযরত উমরও আবু বকর (রা.)’র সুরেই কথা বলেন। কিন্তু এ যাত্রায় হযরত বিলাল (রা.) জিহাদে যাওয়ার সংকল্পে অনড় ছিলেন, ফলে হযরত উমর (রা.) বাধ্য হয়ে তাকে অনুমতি দেন এবং হযরত বিলাল (রা.) সিরিয়ায় চলে যান। হযরত উমর (রা.) যখন তার কাছে জানতে চান যে, তার পর আযান দেওয়ার দায়িত্ব কে পালন করবে, তখন হযরত বিলাল (রা.) হযরত সা’দের নাম প্রস্তাব করেন; কারণ সা’দ (রা.) মহানবী (সা.)-এর জীবদ্দশাতেও আযান দিয়েছিলেন। ফলে হযরত উমর (রা.) হযরত সা’দ ও তার পরে তার সন্তানদের ওপর আযান দেওয়ার দায়িত্ব অর্পণ করেন। সিরিয়ায় মুসলিম-বাহিনীর জয়ের পর যখন হযরত উমর (রা.) সিরিয়া গমন করেন, তখন হযরত উমর (রা.)’র অনুরোধে হযরত বিলাল (রা.) আযান দিয়েছিলেন। বর্ণনাকারীর মতে- ‘সে দিনের পূর্বে আমরা তাকে কখনও এত বেশি কাঁদতে দেখি নি।’ হযরত বিলাল (রা.) যখন সিরিয়ায় ছিলেন, তখন একদিন স্বপ্নে দেখেন, মহানবী (সা.) তার কাছে এসে বলছেন, ‘বিলাল, তুমি তো আমাকে ভুলেই গেছ! আমার কবর যিয়ারত করতেও আর আস না!’ হযরত বিলাল তৎক্ষণাৎ মদীনা অভিমুখে যাত্রা করেন। মদীনায় পৌঁছে তিনি মহানবী (সা.)-এর সমাধিতে গিয়ে এত দোয়া ও কান্নাকাটি করেন যে, খবর ছড়িয়ে পড়ে- বিলাল এসেছেন। হযরত হাসান ও হুসাইন (রা.)ও ততদিনে বেশ বড় হয়ে গিয়েছেন; তারা ছুটে এসে হযরত বিলালের সাথে দেখা করে বলেন, আপনি তো মহানবী (সা.)-এর যুগে আযান দিতেন, আমাদেরকেও আপনার আযান শোনান। হযরত বিলাল (রা.) তখন মদীনায় আযান দেন। সেই আযান শুনে প্রত্যেক মদীনাবাসী শিহরিত হয়ে জেগে ওঠেন; তাদের সবার হৃদয়ে মহানবী (সা.)-এর যুগের সেই স্মৃতি জাগ্রত হয়ে উঠে এবং পুরো মদীনা আবেগে কান্নায় ভেঙে পড়ে।
একটি বর্ণনা থেকে জানা যায়, বনু আবু বুকায়র মহানবী (সা.)-এর কাছে আসে এবং বলে, ‘অমুকের সাথে আমাদের বোনের বিয়ে দিয়ে দিন।’ মহানবী (সা.) বলেন, ‘বিলালের ব্যাপারে তোমাদের মত কী?’ তারা তখন চলে যায়। কয়েকবার এরূপ ঘটে এবং প্রতিবারই মহানবী (সা.) হযরত বিলালের জন্য তাদেরকে প্রস্তাব দেন। শেষবার তিনি তাদেরকে বিলালের প্রস্তাব দিয়ে বলেন, ‘সেই ব্যক্তির ব্যাপারে তোমাদের অভিমত কী, যে জান্নাতের বাসিন্দা?’ তখন তারা হযরত বিলালের সাথে বোনের বিয়ে দিতে সম্মত হয়। হযরত উমর (রা.) তার খিলাফতকালে একবার মক্কায় আসলে মক্কার নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিবর্গ তার সাথে সৌজন্য-সাক্ষাৎ করতে আসে। ঘটনাচক্রে একই সময়ে হযরত বিলাল, আম্মার, সুহায়েব প্রমুখ সাহাবীরাও তার সাথে দেখা করতে আসেন। এই সাহাবীরা যদিও একসময় মক্কার লোকদের ক্রীতদাস ছিলেন, কিন্তু তারা প্রথমদিকে ইসলাম গ্রহণ করে চরম অত্যাচারও সয়েছিলেন এবং মহানবী (সা.)-এর দরবারে তারাই অগ্রগণ্য হতেন। তারা একজন একজন করে আসছিলেন আর হযরত উমর (রা.) মক্কার নেতাদের পিছিয়ে গিয়ে তাদেরকে বসার জায়গা দিতে বলছিলেন; এভাবে পেছাতে পেছাতে তারা কার্যতঃ দরজার বাইরে জুতো রাখার স্থানেই পৌঁছে যায়। এই ঘটনায় তারা খুবই অপমানিত বোধ করে, কিন্তু তাদেরই একজন তখন স্মরণ করিয়ে দেয় যে, তাদের কপালে আজ যে লাঞ্ছনা জুটেছে, তা তাদেরই বাপ-দাদাদের কর্মফলের কারণে হয়েছে। কারণ তাদের বাপ-দাদারা প্রথমদিকে ইসলামের বিরোধিতা করেছে আর এই ক্রীতদাস সাহাবীদের ওপর অত্যাচার চালিয়েছে। তারা যখন হযরত উমর (রা.)’র কাছে গিয়ে এই বিষয়টি বলে এবং জানতে চায়, তাদের এই অপমান থেকে মুক্তির কোন পথ আছে কি-না? হযরত উমর (রা.) সিরিয়ার দিকে ইঙ্গিত করে তাদের বুঝান, এর একমাত্র সমাধান হল আল্লাহ্র পথে জিহাদ করা। সেই যুবকরা সাথে সাথে সিরিয়া অভিমুখে রওয়ানা হয়ে যায়। ইতিহাস থেকে জানা যায়, তাদের একজনও সেই রণক্ষেত্র থেকে আর জীবিত ফিরে আসে নি। এভাবে তারা তাদের পূর্বপুরুষদের অপকর্মের কারণে তাদের কপালে লেগে থাকা কালিমা নিজেদের শরীরের রক্ত দিয়ে মোচন করেছিলেন। হুযূর (আই.) বলেন, এত্থেকে একদিকে যেমন এটি অনুধাবন করা যায় যে, মর্যাদা পেতে হলে ত্যাগ স্বীকার করতে হবে, সেইসাথে ইসলামের এই অনিন্দ্য-সুন্দর শিক্ষাটিও স্পষ্ট হয় যে যারা বড় বড় ত্যাগ স্বীকার করে এবং প্রথম থেকেই বিশ্বস্ততা প্রদর্শন করে, তাদের মর্যাদা অবশ্যই উচ্চ এবং তারাই অগ্রগণ্য, তা সে কৃষ্ণাঙ্গ ক্রীতদাসই হোক বা জাগতিকভাবে অনেক তুচ্ছ ব্যক্তিই হোক না কেন। হুযূর বলেন, হযরত বিলালের স্মৃতিচারণ অব্যাহত রয়েছে, আগামীতে বর্ণনা করা হবে, (ইনশাআল্লাহ্)।