সারমর্ম
এই জুমু’আর খুতবার সারাংশটিতে কোনো প্রকার ত্রুটি-বিচ্যুতি থাকলে তার দায়ভার আহ্মদীয়া বাংলা টীম গ্রহণ করছে।
আহমদীয়া মুসলিম জামা’তের বিশ্ব-প্রধান ও পঞ্চম খলীফাতুল মসীহ্ হযরত মির্যা মসরূর আহমদ (আই.) গত ২৪শে জানুয়ারী, ২০২০ লন্ডনের বায়তুল ফুতুহ মসজিদে প্রদত্ত জুমুআর খুতবায় পূর্বের ধারা অনুসরণে নিষ্ঠাবান বদরী সাহাবীদের বর্ণাঢ্য জীবনের স্মৃতিচারণ করেন। এ খুতবায় তিনি হযরত আবদুল্লাহ্ বিন রওয়াহা (রা.)’র জীবনের স্মৃতিচারণ করেন।
হুযূর (আই.) তাশাহহুদ, তাআ’ব্বুয ও সূরা ফাতিহা পাঠের বলেন, আজ যে সাহাবীর স্মৃতিচারণ করা হবে তার নাম হযরত আব্দুল্লাহ্ বিন রওয়াহা (রা.)। হযরত আব্দুল্লাহ্র পিতার নাম রওয়াহা বিন সা’লাবা এবং মায়ের নাম কাবশা বিনতে ওয়াকেদ বিন আমর, যিনি আনসারদের খাযরাজ গোত্রের বনু হারেস বিন খাযরাজ বংশের সাথে সম্পর্ক রাখতেন। হযরত আব্দুল্লাহ্ বিন রওয়াহা (রা.) আকাবার বয়আতে অংশগ্রহণ করার সৌভাগ্য লাভ করেন। তিনি বনু হারেস বিন খাযরাজের একজন নেতা ছিলেন। জনৈক আনসারের বর্ণনামতে মহানবী (সা.) তার ও হযরত মিকদাদ বিন আসওয়াদের মাঝে ভ্রাতৃত্ব সম্পর্ক স্থাপন করেছিলেন। ইবনে সা’দের মতে তিনি মহানবী (সা.)-এর পত্র-লেখকও ছিলেন। হযরত আব্দুল্লাহ্ বদর, উহুদ, খন্দক, হুদাইবিয়া, খায়বার ও উমরাতুল কাযাসহ সকল যুদ্ধে মহানবী (সা.)-এর সহযোদ্ধা হিসেবে অংশগ্রহণের সৌভাগ্য লাভ করেন। পরিশেষে তিনি মূতার যুদ্ধে শাহাদতবরণের সৌভাগ্য লাভ করেন।
মহানবী (সা.)-এর আনুগত্যের ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন অতুলনীয়। একবার তিনি মহানবী (সা.)-এর কাছে আসছিলেন, হুযূর (সা.) মসজিদে খুতবা দিচ্ছিলেন। খুতবার মাঝে তিনি (সা.) বলেন, ‘বসে যাও’; একথা শুনে বাইরে থাকা আব্দুল্লাহ্ সেখানেই বসে পড়েন। খুতবা শেষ হলে মহানবী (সা.) এ বিষয়টি জানতে পেরে তার জন্য দোয়া করেন, ‘আল্লাহ্ তোমার মাঝে আল্লাহ্ ও রসূলের প্রতি আনুগত্যের স্পৃহা আরও বৃদ্ধি করুন।’ আনুগত্যের অনুরূপ ঘটনা হযরত আব্দুল্লাহ্ বিন মাসউদ (রা.)’র সম্পর্কেও হাদীসগ্রন্থে দেখতে পাওয়া যায়। হযরত আব্দুল্লাহ্ বিন রওয়াহা সবসময় জিহাদের জন্য সবার আগে রওয়ানা হতেন এবং সবার শেষে ফিরতেন। হযরত আবু দারদা (রা.) বর্ণনা করেন, হযরত আব্দুল্লাহ্ বিন রওয়াহার সাথে প্রায় প্রতিদিনই তার দেখা হতো আর তিনি পরম আন্তরিকতার সাথে তার কাঁধে হাত রেখে বলতেন, ‘হে উওয়ায়মের, এসো, বসে কিছুক্ষণ ঈমানকে সতেজ করি!’ তারপর তারা বসে কিছুক্ষণ আল্লাহ্ তা’লার স্মরণ করতেন। ঈমানোদ্দীপক আলোচনা শেষে তিনি বলতেন, ‘এগুলো হল ঈমানের আসর।’ মহানবী (সা.) বলেছিলেন, ‘আল্লাহ্ তা’লা ইবনে রওয়াহার ওপর কৃপা করুন; সে এমন সব মজলিস ভালোবাসে যা নিয়ে ফিরিশতারাও গর্ব করে।’ মহানবী (সা.) তার সম্পর্কে আরও বলেন, ‘আব্দুল্লাহ্ বিন রওয়াহা কতই না ভাল মানুষ!’ খায়বার-বিজয়ের পর মহানবী (সা.) তাকে সেখানকার ফল-ফসলের পরিমাণ নিরূপণ করার জন্য পাঠিয়েছিলেন। একবার তিনি অসুস্থ হলে মহানবী (সা.) তাকে দেখতে যান। তার মা কেঁদে কেঁদে ছেলের সম্পর্কে বলছিলেন, ‘হায় আমার আশ্রয়, আমার অবলম্বন!’ তার রোগের তীব্রতা দেখে তিনি (সা.) দোয়া করেন, ‘হে আল্লাহ্! যদি তার জন্য নির্ধারিত সময় এসে গিয়ে থাকে, তবে তার জন্য এটি সহজ করে দাও; আর যদি তা না হয় তবে তাকে আরোগ্য দান কর।’ হুযূর (সা.)-এর এই দোয়ার পরপরই তার জ্বর অনেকটা কমে যায় আর তিনি নিরাময় হন। হযরত আব্দুল্লাহ্ (রা.) বলেন, “হে আল্লাহ্র রসূল! অসুস্থাবস্থায় আমি একবার একজন ফিরিশ্তাকে দেখি যে, তিনি একটি লোহার গদা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন আর আমার মা যা বলেছেন সে সম্পর্কে আমাকে জিজ্ঞেস করছেন, ‘তোমার মা যা বলছে, আসলেই কি তুমি তা-ই? (কেননা এটি তো শিরকপূর্ণ কথা)’ যদি আমি ‘হ্যাঁ’ বলতাম, তবে সে আমাকে সেই গদা দিয়ে আঘাত করতো।”
হযরত আব্দুল্লাহ্ বিন রওয়াহা (রা.) একজন কবিও ছিলেন, তিনি ছন্দাকারে মহানবী (সা.)-এর বিরুদ্ধবাদীদের অপলাপের জবাব প্রদান করতেন। তিনি অজ্ঞতার যুগেও অনেক সম্মানিত ছিলেন এবং ইসলাম গ্রহণের পরও উচ্চ মর্যাদার অধিকারী ছিলেন। তিনি অজ্ঞতার যুগেও লেখা-পড়া জানতেন। বদরের যুদ্ধে বিজয়ের পর মহানবী (সা.) হযরত যায়েদ বিন হারসাকে মদীনায় এবং আব্দুল্লাহ্ বিন রওয়াহাকে ‘আওয়ালি’ নামক স্থানে বিজয়ের সংবাদ পৌঁছানোর জন্য প্রেরণ করেন। মক্কা বিজয়ের দিন যখন মহানবী (সা.) মসজিদুল হারামের সীমানায় প্রবেশ করেন, তখন তাঁর উটের লাগাম ধরে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছিলেন আব্দুল্লাহ্ বিন রওয়াহা (রা.)। একবার আব্দুল্লাহ্ বিন রওয়াহার অসুস্থাবস্থায় তাকে দেখতে গিয়ে মহানবী (সা.) উম্মতের শহীদ কারা- এ বিষয়ে প্রশ্ন করলে সাহাবীরা আল্লাহ্র পথে যুদ্ধ করে নিহতদের শহীদ আখ্যায়িত করেন। মহানবী (সা.) বলেন, ‘তাহলে তো আমার উম্মতের মধ্যে শহীদের সংখ্যা অনেক কমে যাবে! নিহত মুসলমানও শহীদ, উদরের অসুখে মৃত্যুবরণকারীও শহীদ, পানিতে ডুবে মৃত্যুবরণকারীও শহীদ, আর সন্তান প্রসবকালে মৃত্যুবরণকারী নারীও শহীদ।’
মহানবী (সা.) মূতার যুদ্ধের জন্য হযরত যায়েদ বিন হারসা (রা.)-কে নেতা মনোনীত করেন, কিন্তু সাথে এ-ও বলে দেন, যদি যায়েদ শহীদ হয়ে যায় তবে হযরত জা’ফর বিন আবু তালিব নেতা হবেন। যদি তিনিও শহীদ হন, তবে আব্দুল্লাহ্ বিন রওয়াহা নেতা হবেন। যদি তিনি-ও শহীদ হন, তবে মুসলমানরা যাকে সঙ্গত মনে করবে, তিনি-ই নেতৃত্বভার গ্রহণ করবেন। মহানবীর একথা শুনে সেখানে উপস্থিত এক ইহুদী বলেছিল যদিও আমি মুহাম্মদকে নবী বলে বিশ্বাস করি না কিন্তু যদি তার কথা সত্য হয় তাহলে তোমাদের তিনজনের কেউই আর প্রাণে ফিরে আসতে পারবে না, কেননা নবীর কথা কোনদিনও মিথ্যা হতে পারে না। মহানবী (সা.)-এর একথা শুনেই হযরত আব্দুল্লাহ্ বুঝতে পেরেছিলেন, তার শাহাদতের সময় ঘনিয়ে এসেছে। এরপর তিনি শাহাদতের জন্য ব্যাকুল আকাঙ্কক্ষা ব্যক্ত করে কাব্য রচনা করেন। তিনি মহানবী (সা.)-এর সাথে শেষবারের মত দেখা করেন। মূতার যুদ্ধ যা সিরিয়াতে রোমান বাহিনীর সাথে সংঘটিত হয়েছিল, তাতে রোমান বাহিনীর সংখ্যা ছিল দু’লাখ, অপরদিকে মুসলমানরা সংখ্যায় ছিল মাত্র তিন হাজার। কিন্তু আব্দুল্লাহ্ বিন রওয়াহা (রা.) মুসলমানদের উদ্বুদ্ধ ও অনুপ্রাণিত করেন এবং তারা এত স্বল্পসংখ্যক হওয়া সত্ত্বেও রোমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন। অতঃপর তিনজন নেতাই একে একে বীরত্বের সাথে লড়াই করে শহীদ হন, এরপর হযরত খালিদ বিন ওয়ালিদ নেতৃত্বভার গ্রহণ করেন আর বিজেতা হিসেবে মুসলমানদেরকে নিরাপদে মদীনায় ফিরিয়ে নিয়ে আসেন। মহানবী (সা.) আল্লাহ্ তা’লার কাছে তিনবার যায়েদের জন্য এবং জা’ফর ও আব্দুল্লাহ্র জন্য একবার করে ক্ষমা লাভের দোয়া করেন।
বদরের যুদ্ধের পূর্বে একদিন মহানবী (সা.) একজন অসুস্থ সাহাবী হযরত সা’দ বিন উবাদা (রা.)-কে দেখতে যাচ্ছিলেন, পথিমধ্যে আব্দুল্লাহ্ বিন উবাই বিন সলুল ও তার সাথে থাকা একদল লোকের সাথে তাঁর দেখা হয়। তিনি (সা.) তাদেরকে আল্লাহ্র দিকে আহ্বান করে কুরআন শোনালে উবাই বিন সলুল চরম ধৃষ্টতা প্রদর্শনপূর্বক বলে, তাদের সভায় এসে এসব কথা শোনানোর কোন দরকার নেই। হযরত আব্দুল্লাহ্ বিন রওয়াহা (রা.), যিনি সেখানে উপস্থিত ছিলেন, কারও তোয়াক্কা না করে তৎক্ষণাৎ বলে উঠেন, ‘হে আল্লাহ্র রসূল! আপনি আমাদের সভায় আসবেন; আমরা এসব শুনতে ভালবাসি।’ মহানবী (সা.) একবার একটি অভিযানে একদল সাহাবীকে প্রেরণ করেন, যাদের মধ্যে আব্দুল্লাহ্ বিন রওয়াহা (রা.)ও ছিলেন। বাকিরা রওয়ানা হয়ে গেলেও আব্দুল্লাহ্ মহানবী (সা.)-এর সাথে জুমুআর নামায পড়ে রওয়ানা হতে চাইলেন। জুমুআর নামাযে মহানবী (সা.) তাকে দেখতে পেয়ে রওয়ানা না হওয়ার কারণ জানতে চান। কারণ জানার পর রসূল (সা.) বলেন, ‘পৃথিবীতে যা কিছু আছে, তার সবকিছু খরচ করলেও তুমি তাদের সমান কৃপা বা আশিস লাভ করতে পারবে না যারা ইতোমধ্যেই অভিযানের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়েছে।’ হুযূর বলেন, অভিযানের প্রয়োজনে জুমুআর নামায পরিত্যাগ করার বা অন্যত্র পড়ারও ব্যবস্থা হতে পারে। একবার রমযানের প্রচন্ড গরমের মাঝে সাহাবীরা মহানবী (সা.)-এর সাথে কোন কাজে বের হন। গরমের তীব্রতার কারণে তারা কেউ রোযা ছিলেন না, সেদিন কেবল রসূলুল্লাহ্ (সা.) এবং আব্দুল্লাহ্ বিন রওয়াহা (রা.) রোযা রেখেছিলেন। মসজিদে নববীর নির্মাণকালে সাহাবীরা সুর করে যে পঙক্তিগুলো পড়তেন- ‘হাযাল হিমালু লা হিমালা খায়বারা- হাযা আবার রাব্বানা ওয়া আতহার’, ‘আল্লাহুম্মা ইন্নাল আজরা আজরুল আখিরাহ্- ফারহামিল আনসারা ওয়াল মুহাজিরা’- এগুলো আব্দুল্লাহ্ বিন রওয়াহা-ই রচনা করেছিলেন।
খুতবার শেষদিকে হুযূর একটি গায়েবানা জানাযা পড়ানোর ঘোষণা দেন যা মরহুম মঞ্জুর আহমদ কুরাইশি সাহেবের পুত্র ডা. লতিফ আহমদ কুরাইশি সাহেবের, যিনি গত ১৯শে জানুয়ারি দুপুর প্রায় ১টার দিকে ৮০ বছর বয়সে আল্লাহ্র ইচ্ছায় পরলোক গমন করেন, ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন। মরহুম ভারতের আজমীর শরীফে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। দেশ বিভাগের পর পরিবারের সাথে লাহোরে চলে আসেন। সেখানে তিনি সবচেয়ে কম বয়সে এমবিবিএস পাস করে রেকর্ড গড়েন। পরবর্তীতে লন্ডনে গিয়ে চিকিৎসা শাস্ত্রে বিভিন্ন উচ্চতর ডিগ্রি অর্জন করেন ও প্র্যাকটিস করতে থাকেন। পরবর্তীতে হযরত খলীফাতুল মসীহ্ সালেস (রাহে.)’র আহ্বানে ওয়াকফ করে রাবওয়া চলে যান এবং ফযলে উমর হাসপাতালে দীর্ঘ ত্রিশ বছর সেবা করার সৌভাগ্য লাভ করেন। এছাড়া জামাতের আরও বিভিন্ন বিভাগে তিনি মূল্যবান সেবা প্রদানের সৌভাগ্য লাভ করেন। হুযূর মরহুমের বর্ণাঢ্য কর্মময় জীবনের সংক্ষিপ্ত স্মৃতিচারণ করেন এবং তার রূহের মাগফিরাতের জন্য দোয়া করেন, একইসাথে তার বংশধরদের মাঝে যেন তার পুণ্য চলমান থাকে সেজন্যও দোয়া করেন। (আমীন)