সারমর্ম
এই জুমু’আর খুতবার সারাংশটিতে কোনো প্রকার ত্রুটি-বিচ্যুতি থাকলে তার দায়ভার আহ্মদীয়া বাংলা টীম গ্রহণ করছে।
আহমদীয়া মুসলিম জামা’তের বিশ্ব-প্রধান ও পঞ্চম খলীফাতুল মসীহ্ হযরত মির্যা মসরূর আহমদ (আই.) গত ১১ই জুন, ২০২০ ইসলামাবাদের মসজিদে মুবারকে প্রদত্ত জুমুআর খুতবায় পূর্বের ধারা অনুসরণে নিষ্ঠাবান বদরী সাহাবীদের বর্ণাঢ্য জীবনের স্মৃতিচারণ করেন। এ খুতবায় তিনি হযরত সাঈদ বিন যায়েদ (রা.)’র জীবনের স্মৃতিচারণ করেন।
তাশাহহুদ, তাআ’ব্বুয ও সূরা ফাতিহা পাঠের পর হুযূর (আই.) বলেন, আজ আমি যে সাহাবীদের স্মৃতিচারণ করব তাদের একজন হলেন, হযরত সাঈদ বিন যায়েদ (রা.); তার পিতার নাম ছিল যায়েদ বিন আমর আর মায়ের নাম ছিল ফাতেমা বিনতে বা’জা, তিনি কুরাইশদের আদী বিন কা’ব বিন লুয়াই গোত্রভুক্ত ছিলেন। হযরত সাঈদের ডাকনাম ছিল আবুল আ’ওয়ার, তিনি দীর্ঘকায় ও গোধুম বর্ণের অধিকারী ছিলেন, তার মাথায় ঘন চুল ছিল। তিনি হযরত উমর (রা.)’র চাচাতো ভাই ও ভগ্নিপতি ছিলেন, তার বংশতালিকায় অষ্টম পূর্বপুরুষ লুয়াই মহানবী (সা.)-এরও পূর্বপুরুষ ছিলেন। হযরত সাঈদের বোন আতিকা ছিলেন হযরত উমর (রা.)’র সহধর্মিনী, আর তিনি বিয়ে করেছিলেন হযরত উমর (রা.)’র বোন হযরত ফাতেমাকে; আর তার মাধ্যমেই হযরত উমর (রা.) ইসলাম গ্রহণের সৌভাগ্য লাভ করেছিলেন।
হযরত সাঈদের পিতা যায়েদ বিন আমর অজ্ঞতা ও পৌত্তলিকতার যুগেও একেশ্বরবাদী ছিলেন এবং সবসময় ইব্রাহীম (আ.)-এর ধর্মের সন্ধানে থাকতেন আর বলতেন, ‘আমার খোদা তিনি-ই যিনি ইব্রাহীমের খোদা, আর আমার ধর্ম তা-ই যা ইব্রাহীমের ধর্ম।’ হযরত যায়েদ অজ্ঞতার যুগেও সবরকম পাপ-পঙ্কিলতা এড়িয়ে চলতেন, এমনকি কুরাইশদের জবাই করা পশুর মাংসও খেতেন না। বুখারী শরীফের বর্ণনা থেকে জানা যায়, মহানবী (সা.)-এর নবুয়ত লাভের পূর্বে একদিন মহানবী (সা.) ও যায়েদ বিন আমরের সামনে খাবার হিসেবে মাংস উপস্থাপন করা হলে মহানবী (সা.) তা খেতে অস্বীকৃতি জানান; তখন যায়েদ বলেন, আমিও প্রতিমার নামে বলি দেয়া মাংস খাই না, কেবল আল্লাহ্র নামে জবাইকৃত পশুর মাংস খাই। যায়েদ বিন আমর কুফর ও শিরকের প্রতি বীতশ্রদ্ধ ছিলেন এবং সত্য ধর্মের সন্ধানে অনেক দূরদেশেও ভ্রমন করেছেন। সহীহ্ বুখারীতে বর্ণিত হয়েছে, একবার তিনি সিরিয়ায় গিয়ে এক ইহুদী পণ্ডিতের সাথে আলোচনা করেন ও ইহুদী ধর্ম গ্রহণ করার আগ্রহ প্রকাশ করেন; ইহুদী আলেম তাকে এমনটি করতে বারণ করে বলেন, তাদের ধর্ম বিকৃত হয়ে গেছে, আর তাকে ইব্রাহীম (আ.)-এর দ্বীনে হানীফ তথা এক খোদার ইবাদতের উপদেশ দেন। যায়েদ তখন এক খ্রিস্টান আলেমের সাথে দেখা করেন, খ্রিস্টান আলেমও তাকে একই উপদেশ দেন। তখন থেকেই যায়েদ বিন আমর নিজেকে ইব্রাহীম (আ.)-এর ধর্মের অনুসারী গণ্য করতেন, আর তিনি হযরত ইসমাঈলের বংশধরদের মাঝ থেকে এক নবীর আগমনের ও তাকে মান্য করার প্রতীক্ষায় ছিলেন, তবে তিনি মহানবী (সা.)-এর নবুয়তের দাবীর পূর্বেই মৃত্যুবরণ করেন। প্রাসঙ্গিকভাবে হুযূর এ-ও বলেন, কখনও কখনও জামাতের নবীনরা প্রশ্ন করে, নবুওয়তের পূর্বে মহানবী (সা.) কোন ধর্মের অনুসরণ করতেন; এই বর্ণনাগুলোতে তাদের প্রশ্নের উত্তর রয়েছে। হযরত সাঈদ ও হযরত উমর (রা.) একবার মহানবী (সা.)-এর কাছে যায়েদ বিন আমর সম্পর্কে প্রশ্ন করলে মহানবী (সা.) বলেন, ‘আল্লাহ্ যায়েদ বিন আমরকে ক্ষমা করুন ও তার প্রতি কৃপা করুন, তিনি ইব্রাহিমের ধর্মের অনুসারী অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেছেন।’ আরেকবার মহানবী (সা.) তার সম্পর্কে বলেন, ‘কিয়ামতের দিন যায়েদ বিন আমর একাই একটি জাতির আকারে পুনরুত্থিত হবেন।’
হযরত সাঈদ বিন যায়েদ ও তার স্ত্রী হযরত ফাতেমা বিনতে খাত্তাব একেবারে প্রথমদিকে ইসলাম গ্রহণকারীদের অন্যতম ছিলেন, তারা দ্বারে আরকাম যুগের পূর্বেই ইসলাম গ্রহণ করেন। হযরত সাঈদের স্মৃতিচারণের প্রেক্ষিতে হুযূর হযরত উমর (রা.)’র ইসলাম গ্রহণের ঈমানোদ্দীপক ঘটনাটি আরও একবার সংক্ষেপে বর্ণনা করেন। হযরত সাঈদ প্রথমদিকের মুহাজিরদের একজন ছিলেন। হিজরতের পর মহানবী (সা.) হযরত রা’ফে বিন মালেক (রা.)’র সাথে তার ভ্রাতৃত্ব-সম্পর্ক স্থাপন করেন; অপর এক বর্ণনামতে তার ধর্মভাই ছিলেন হযরত উবাই বিন কা’ব (রা.)। হযরত সাঈদ বদরের যুদ্ধে সরাসরি অংশগ্রহণ করতে পারেন নি, কিন্তু মহানবী (সা.) তাকে যুদ্ধলদ্ধ সম্পদের অংশ প্রদান করেছিলেন। যুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে না পারার কারণ ছিল মহানবী (সা.) তাকে ও হযরত তালহা বিন উবায়দুল্লাহ্ (রা.)-কে কুরাইশদের সিরিয়া-ফেরত বাণিজ্য কাফেলার সংবাদ সংগ্রহের জন্য প্রেরণ করেছিলেন, তারা সংবাদ নিয়ে ফেরত আসার পূর্বেই মহানবী (সা.) অন্য সূত্রে সংবাদ পেয়ে সাহাবীদের সাথে নিয়ে অভিযানের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেছিলেন; তারা দু’জন যেদিন মদীনায় ফিরে আসেন সেদিনই বদরের যুদ্ধ সংঘটিত হয়। কিন্তু এরপরও তারা মহানবী (সা.)-এর মিলিত হওয়ার বাসনায় মদীনা হতে বদরের অভিমুখে উনিশ মাইল এগিয়ে যান এবং বদর ফেরত মহানবী (সা.)-এর সাথে তাদের তুরবান নামক স্থানে সাক্ষাৎ হয়, তাই মহানবী (সা.) তাদের দু’জনে বদরী সাহাবীদের মাঝে গণ্য করেন। হযরত সাঈদ বিন যায়েদ (রা.) ‘আশারায়ে মুবাশ্শারা’ বা সেই দশজন সৌভাগ্যবান সাহাবীর একজন ছিলেন, যাদেরকে মহানবী (সা.) তাদের জীবদ্দশাতেই জান্নাতের সুসংবাদ প্রদান করেছিলেন; আশারায়ে মুবাশ্শারার অন্য সাহাবীরা হলেন, হযরত আবু বকর, হযরত উমর, হযরত উসমান, হযরত আলী, হযরত তালহা বিন উবায়দুল্লাহ্, হযরত যুবায়ের ইবনুল আওয়াম, হযরত আব্দুর রহমান বিন অওফ, হযরত সা’দ বিন আবি ওয়াক্কাস ও হযরত আবু উবায়দা ইবনুল জাররাহ্ (রা.); তাঁরা সবাই যুদ্ধক্ষেত্রে মহানবী (সা.)-এর সম্মুখভাগে তাঁর সুরক্ষায় নিবেদিত থাকতেন, আর নামাযের সময় তাঁর (সা.) পিছনে দাঁড়িয়ে নামায পড়তেন।
এক বর্ণনা থেকে জানা যায়, হযরত সাঈদ বিন যায়েদ (রা.)’র আংটিতে কুরআনের আয়াত খোদাই করা ছিল। হযরত উমর (রা.)-এর খিলাফতকালে সিরিয়ার যুদ্ধে হযরত আবু উবায়দার অধীনে হযরত সাঈদ পদাতিক বাহিনীর সেনানায়ক ছিলেন, দামেস্ক অবরোধ ও রোমকের যুদ্ধেও তিনি অসামান্য বীরত্ব প্রদর্শন করেন। যুদ্ধ চলাকালেই হযরত সাঈদকে দামেস্কের গভর্ণর নিযুক্ত করা হলে তিনি হযরত আবু উবায়দাকে চিঠি লিখে জানান, আপনারা জিহাদ করবেন আর আমি তা থেকে বঞ্চিত থাকব- এটি হতে পারে না, আমার স্থলে অন্য কাউকে প্রেরণ করুন। তখন হযরত আবু উবায়দা বাধ্য হয়ে সেই পদে ইয়াযিদ বিন আবু সুফিয়ানকে নিযুক্ত করেন এবং হযরত সাঈদ পুনরায় জিহাদে অংশগ্রহণ করেন। তার চোখের সামনে অনেক বিপ্লব সংঘটিত হয়, অনেক গৃহযুদ্ধ হয়- কিন্তু তিনি নিজ খোদাভীতি ও জগদ্বিমুখতার কারণে সবরকম বিভেদ ও বিশৃক্সক্ষলা এড়িয়ে চলতে সক্ষম হন। তবে কারও সম্পর্কে নিজ মনোভাব প্রকাশ করতেও তিনি কখনও দ্বিধা করতেন না; হযরত উসমান (রা.)’র শাহাদতের পর প্রায়ই তিনি কুফার মসজিদে বলতেন, ‘উসমানের সাথে তোমরা যা করেছ, তার ফলে উহুদ পাহাড় বিদীর্ণ হয়ে যাওয়াও আশ্চর্য কিছু নয়।’ আরেকবার মুগীরা বিন শুব কুফার জামে মসজিদে হযরত আলী সম্পর্কে আজেবাজে মন্তব্য করলে তিনি অত্যন্ত তীব্র প্রতিক্রিয়া প্রদর্শন করেন। একবার আরওয়া নাম্নী এক মহিলা হযরত সাঈদের নামে মিথ্যা অভিযোগ করে যে, তিনি অন্যায়ভাবে তার জমি দখল করে রেখেছেন। হযরত সাঈদ এই অপবাদের প্রেক্ষিতে দোয়া করেন, হে আল্লাহ্! আরওয়া যদি মিথ্যা বলে থাকে তবে তুমি তাকে অন্ধ করার পূর্বে মৃত্যু দিও না, আর তার বাড়ির কুঁয়া যেন তার কবর হয়। বাস্তবে এমনটিই হয়েছিল, আরওয়া অন্ধ হয়ে যায় এবং একদিন নিজ বাড়ির কুঁয়ায় পড়ে গিয়ে মারা যায়; আরওয়ার অন্ধ হওয়ার বিষয়টি আরবের প্রবাদবাক্যে পরিণত হয়।
হযরত সাঈদ ৫০ অথবা ৫১ হিজরিতে প্রায় ৭০ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন, কারও কারও মতে তিনি সত্তোরর্ধ ছিলেন। হযরত আব্দুল্লাহ্ বিন উমর (রা.) হযরত সাঈদের মৃত্যুর খবর শুনতে পেয়ে জুমুআর প্রস্তুতি বাদ দিয়ে দ্রুত আকিক নামক স্থানে যান যেখানে হযরত সাঈদ (রা.) বসবাস করতেন; তিনি তার জানাযাও পড়ান। হযরত আব্দুল্লাহ্ বিন উমর ও হযরত সা’দ বিন আবি ওয়াক্কাস (রা.) হযরত সাঈদ (রা.)’র কবরে অবতরণ করে তার মরদেহ সমাহিত করেন। হযরত সাঈদ (রা.) বিভিন্ন সময়ে দশটি বিয়ে করেছিলেন এবং তার ১৩ জন পুত্র আর ১৯জন কন্যা সন্তান ছিলেন।
এরপর হুযূর হযরত আবদুর রহমান বিন অওফ (রা.)-এর আংশিক স্মৃতিচারণ করেন; অজ্ঞতার যুগে তার নাম ছিল আবদে আমর বা আবদুল কা’বা, ইসলাম গ্রহণের পর মহানবী (সা.) তার নাম বদলে আব্দুর রহমান রাখেন। তিনি বনু যুহরা বিন কিলাব গোত্রভুক্ত ছিলেন। তিনি ফর্সা ছিলেন, তার সুন্দর চোখ, সুউচ্চ নাক, কানের লতি পর্যন্ত দীর্ঘ চুল ছিল। তিনি দীর্ঘকায় ও খুবই সুদর্শন ছিলেন, উহুদের যুদ্ধে প্রাপ্ত একটি আঘাতের কারণে তিনি কিছুটা খুঁড়িয়ে চলতেন। হযরত আব্দুর রহমান বিন অওফ-ও আশারায়ে মুবাশ্শারার একজন ছিলেন; হযরত উমর (রা.) তাকে খিলাফত নির্বাচন কমিটির ছয় সদস্যের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন। তিনি সেই মুষ্টিমেয় ব্যক্তিদের একজন ছিলেন যারা অজ্ঞতার যুগেও মদ্যপানকে নিজেদের জন্য হারাম গণ্য করতেন। তিনি আব্রাহার হস্তিবাহিনীর কা’বা আক্রমণচেষ্টার ঘটনার দশ বছর পরে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি দ্বারে আরকাম যুগের পূর্বেই হযরত আবু বকর (রা.)’র তবলীগে ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন। তিনি আবিসিনিয়ার উভয় হিজরতেই অংশগ্রহণ করেন। মদীনায় হিজরতের পর মহানবী (সা.) তার ও হযরত সা’দ বিন রবী (রা.)’র মধ্যে ভ্রাতৃত্ব স্থাপন করেন, এর ফলে হযরত সা’দ তাকে নিজের যাবতীয় সম্পদের অর্ধেক দিয়ে দিতে চান, এমনকি দু’জন স্ত্রীর একজনকে তালাক দিতে চান যেন ইদ্দত পূর্ণ হওয়ার পর আব্দুর রহমান তাকে বিয়ে করতে পারেন। হযরত আব্দুর রহমান বিন অওফ (রা.) তার এই প্রস্তাব গ্রহণে অস্বীকৃতি জানিয়ে তার কাছে নিকটস্থ বাজারের সন্ধান করেন, অতঃপর তিনি পরদিন থেকেই কায়নুকা’র বাজারে গিয়ে ঘি ও পনীরের ব্যবসা শুরু করেন। আল্লাহ্ তা’লা তার ব্যবসায় অশেষ বরকত দেন, এমনকি হযরত আব্দুর রহমান নিজেই বলতেন- আমার মনে হতো আমি যদি পাথরও উঠাই তবে তার নিচেও স্বর্ণ বা রূপা পাওয়া যাবে।
হযরত আব্দুর রহমান বিন অওফ (রা.) এক অকুতোভয় যোদ্ধা ছিলেন এবং যুদ্ধক্ষেত্রে তিনি বিশিষ্ট জেনারেলদের অন্যতম পরিগণিত হতেন। বদরের যুদ্ধের দিন যে দু’জন আনসারী বালকের আক্রমণে আবু জাহল নিহত হয়েছিল, তারা যুদ্ধক্ষেত্রে হযরত আব্দুর রহমান বিন অওফের-ই দু’পাশে ছিলেন, আর তারা আব্দুর রহমানের কাছেই অনুরোধ করেছিলেন আবু জাহলকে চিনিয়ে দেওয়ার জন্য। আবু জাহলের নিহত হওয়ার বরাতে হুযূর সাহাবীদের নিষ্ঠা ও আত্মনিবেদনের সেই ঐতিহাসিক ঘটনাটি পুনরায় বর্ণনা করেন এবং এ সম্পর্কে হযরত মুসলেহ্ মওউদ (রা.) বক্তব্যও তুলে ধরেন। অতঃপর হুযূর বলেন, হযরত আব্দুর রহমান বিন অওফ (রা.)’র অবশিষ্ট স্মৃতিচারণ পরবর্তীতে করা হবে, ইনশাআল্লাহ্।