সারমর্ম
এই জুমু’আর খুতবার সারাংশটিতে কোনো প্রকার ত্রুটি-বিচ্যুতি থাকলে তার দায়ভার আহ্মদীয়া বাংলা টীম গ্রহণ করছে।
আহমদীয়া মুসলিম জামা’তের বিশ্ব-প্রধান ও পঞ্চম খলীফাতুল মসীহ্ হযরত মির্যা মসরূর আহমদ (আই.) গত ১৯শে জুন, ২০২০ ইসলামাবাদের মসজিদে মুবারকে প্রদত্ত জুমুআর খুতবায় পূর্বের ধারা অনুসরণে নিষ্ঠাবান বদরী সাহাবীদের বর্ণাঢ্য জীবনের স্মৃতিচারণ করেন। এ খুতবায় তিনি হযরত আব্দুর রহমান বিন অওফ (রা.)’র জীবনের স্মৃতিচারণ করেন।
তাশাহহুদ, তাআ’ব্বুয ও সূরা ফাতিহা পাঠের পর হুযূর (আই.) বলেন, গত খুতবায় হযরত আব্দুর রহমান বিন অওফের স্মৃতিচারণ সম্পন্ন হয় নি তাই আজ আমি তাঁর কথাই করব। কুরাইশ নেতা উমাইয়া বিন খালফের সাথে হযরত আব্দুর রহমান বিন অওফের পুরনো বন্ধুত্ব ছিল। হিজরতের পর তিনি উমাইয়াকে চিঠি লিখেন যেন সে মক্কায় তার সহায়-সম্পত্তির দেখাশোনা করে, প্রতিদানে তিনিও মদীনায় তার সম্পত্তির দেখাশোনা করবেন। মূলতঃ এ কারণেই বদরের যুদ্ধের দিন যখন কুরাইশদের পরাজয়ের পর উমাইয়া হযরত আব্দুর রহমানের কাছে আশ্রয় ভিক্ষা করে, তখন তিনি তাকে বাঁচানোর সর্বাত্মক চেষ্টা করেন। হযরত আব্দুর রহমান বিন অওফ (রা.) উমাইয়া ও তার ছেলে আলীর হাত ধরে তাদের নিরাপদ স্থানে নিয়ে যাচ্ছিলেন, হঠাৎ হযরত বেলাল তাদের দেখে ফেলেন ও হৈচৈ শুরু করেন। হযরত আব্দুর রহমান হযরত বেলালকে নিরস্ত করার জন্য বলেন, ‘বেলাল, এরা দু’জন আমার বন্দী।’ কিন্তু বেলাল তবুও বলতে থাকেন, ‘এ হল উমাইয়া বিন খালফ! সে যদি আজ প্রাণে বেঁচে যায় তবে আমার রক্ষা নেই।’ অতঃপর বেলাল উচ্চস্বরে আনসারদের ডাকতে থাকেন। হযরত বেলালের আহ্বানে সাহাবীরা ছুটে আসেন এবং উমাইয়া ও তার পুত্রকে হত্যা করেন। হযরত বেলাল (রা.) মক্কায় থাকাকালীন উমাইয়ার ক্রীতদাস ছিলেন আর ইসলাম ত্যাগ করার জন্য সে তার ওপর চরম নির্যাতন করতো, মরুভূমির তপ্ত পাথরের ওপর শুইয়ে তার বুকে ভারী পাথর চাপিয়ে দিত; হযরত বেলাল তবুও ‘আহাদ আহাদ’ বলতে থাকতেন। হযরত আব্দুর রহমান (রা.) উহুদের যুদ্ধেও অংশগ্রহণ করেছিলেন। উহুদের যুদ্ধের দিন যখন মুসলমানরা ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়ে, তখন তিনি মহানবী (সা.)-এর সাথে যুদ্ধক্ষেত্রে অবিচল ছিলেন। উহুদের যুদ্ধের দিন তার শরীরে মোট ২১টি আঘাত লাগে, সেদিনের একটি আঘাতের কারণে বাকি জীবন তিনি একটু খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটতেন; উহুদের যুদ্ধে তার সামনের পাটির দু’টি দাঁতও শহীদ হয়েছিল।
৬ষ্ঠ হিজরীর শাবান মাসে মহানবী (সা.) হযরত আব্দুর রহমান বিন অওফ (রা.)’র নেতৃত্বে সাতশ’ মুসলমানকে দুমাতুল জানদালে প্রেরণ করেন। মহানবী (সা.) স্বীয় পবিত্র হাতে তার মাথায় কালো রঙয়ের পাগড়ি বেঁধে দেন ও তাকে বিভিন্ন দিকনির্দেশনা প্রদান করেন। মহানবী (সা.) তাকে সেখানে গিয়ে প্রথমে তিনদিন সেখানকার বাসিন্দাদেরকে ইসলামের দিকে আহ্বান করার নির্দেশ দেন; আর একান্ত অপারগতায় যদি যুদ্ধ করতেই হয় তবে তারা যেন কোনরূপ ধোঁকাবাজি বা বিশ্বাসঘাতকতার আশ্রয় না নেন এবং নারী ও শিশুদের হত্যা না করেন- সে সম্পর্কে জোরালো নির্দেশ দেন। হযরত আব্দুর রহমান (রা.) সেখানে পৌঁছে তিনদিন পর্যন্ত তাদেরকে তবলীগ করেন, কিন্তু তারা অস্বীকার করতে থাকে। অবশেষে তাদের একজন খ্রিস্টান নেতা আসবাগ বিন আমর ক্বালবি ইসলাম গ্রহণ করেন। হযরত আব্দুর রহমান এরপর মহানবী (সা.)-এর নির্দেশে আসবাগের মেয়ে তামাযিরকে বিয়ে করে মদীনায় নিয়ে আসেন, যিনি পরবর্তীতে উম্মে আবু সালামা নামে পরিচিত হন।
চতুর্দশ হিজরীতে সংঘটিত জিসর বা পুলের যুদ্ধে মুসলিম বাহিনীর নেতা হযরত উবায়েদ বিন মাসউদ (রা.)’র শাহাদতের সংবাদ যখন হযরত উমর (রা.)-এর কাছে পৌঁছে, তখন তিনি আনসার ও মুহাজিরদেরকে জিহাদের জন্য আহ্বান করে নিজেও মদীনা থেকে যাত্রা করেন। তিনি যখন সিরার নামক স্থানে অবস্থানরত ছিলেন, তখন তিনি সাহাবীদের সাথে যুদ্ধে যাওয়ার ব্যাপারে পরামর্শ করেন। শীর্ষস্থানীয় সাহাবীরা সবাই তাকে যুদ্ধে অংশগ্রহণের পরামর্শ দেন, একমাত্র হযরত আব্দুর রহমান বিন অওফ (রা.) ছাড়া; তিনি অত্যন্ত বিনয় ও জোরের সাথে অনুরোধ করেন- খলীফা স্বয়ং এই যুদ্ধে না গিয়ে এর পরিবর্তে যেন একটি বিশাল বাহিনী প্রেরণ করেন। হযরত আব্দুর রহমান (রা.) শংকা প্রকাশ করেন, আল্লাহ্ না করুন, যদি খলীফার উপস্থিতিতে যুদ্ধে পরাজয় হয় বা খলীফা স্বয়ং শহীদ হন, তাহলে মুসলমানরা আর আল্লাহ্র নাম নেয়ার, তাঁর শ্রেষ্ঠত্ব ও মহিমা ঘোষণা করার সামর্থ্য রাখবে না। অর্থাৎ, তারা মনোবল হারিয়ে ফেলবে। অতঃপর হযরত উমর (রা.) তার পরামর্শ মেনে নেন এবং সেমতে হযরত সা’দ বিন মালেক (রা.)’র নেতৃত্বে বড় একটি বাহিনী প্রেরণ করেন।
হযরত আব্দুর রহমান (রা.)’র এই সৌভাগ্যও হয়েছিল যে, তাবূক যুদ্ধের সফরে একদিন ফজরের নামাযে তার ইমামতিতে মহানবী (সা.)-ও নামায পড়েছিলেন এবং বলেছিলেন, ‘প্রত্যেক নবী তাঁর জীবনে নিজ উম্মতের কোন পুণ্যবান ব্যক্তির পিছনে অবশ্যই নামায পড়েন।’ এভাবে তিনি (সা.) হযরত আব্দুর রহমান (রা.)-কে অনেক বড় সম্মানে ভূষিত করেন। হযরত আব্দুর রহমান বিন অওফ (রা.) সবসময় যোহরের নামাযের পূর্বে দীর্ঘ নফল পড়তেন আর আযান হলে মসজিদে চলে যেতেন। একবার হযরত আব্দুর রহমান (রা.) কা’বা তওয়াফ করতে করতে এই দোয়া করছিলেন, ‘হে আল্লাহ্! আমাকে আত্মার কার্পণ্য থেকে রক্ষা করো।’ হযরত উমর (রা.) যে বছর খলীফা নির্বাচিত হন, সে বছর তিনি আব্দুর রহমান (রা.)-কে হজ্জ্বের আমীর নিযুক্ত করেন। হযরত আব্দুর রহমান বিন অওফ (রা.) মহানবী (সা.)-এর কাছ থেকে উকুনের সমস্যার কারণে রেশমী কাপড় পরার অনুমতি নিয়েছিলেন। হযরত উমর (রা.)’র খিলাফতকালে তার পুত্র আবু সালামা রেশমী জামা পরে পিতার সাথে খলীফা উমর (রা.)’র সাথে দেখা করতে যান, হযরত উমর (রা.) তা দেখে ছিঁড়ে ফেলেন। তখন আব্দুর রহমান তাকে স্মরণ করান, মহানবী (সা.) তাকে রেশমী কাপড় পরিধানের অনুমতি দিয়েছিলেন। হযরত উমর (রা.) বলেন, ‘মহানবী (সা.) আপনাকে এজন্য অনুমতি দিয়েছিলেন যে, আপনি উকুনের সমস্যার কথা বলেছিলেন, আর সেই অনুমতি আপনি ছাড়া অন্য কারও জন্য প্রযোজ্য নয়।’ হযরত আব্দুর রহমান (রা.) হিজরত করে রিক্তহস্তে মদীনায় এসেছিলেন, কিন্তু আল্লাহ্ তার ব্যবসা-বাণিজ্য, ধন-সম্পদ ও রিয্ক-এ এতটাই প্রাচুর্য দান করেছিলেন যে, সাহাবীরা তাকে কখনো কখনো চার-পাঁচশ’ দিরহামের মূল্যেবান পোশাকও পরিধান করতে দেখেছেন।
হযরত আবু বকর (রা.) নিজের মৃত্যুর পূর্বে হযরত উমর (রা.)-কে খলীফা নির্ধারণ করে যান। তিনি এ বিষয়ে হযরত আব্দুর রহমান (রা.)’র সাথে পরামর্শ করেছিলেন যে, হযরত উমর সম্পর্কে তার অভিমত কী? হযরত আব্দুর রহমান (রা.) হযরত উমরের ভূয়সী প্রশংসার পাশাপাশি এই মন্তব্যও করেন যে, তিনি কিছুটা কঠোর প্রকৃতির। হযরত আবু বকর (রা.) তখন বলেছিলেন, হযরত উমরের কঠোরতার কারণ ছিল তার নিজের কোমলতা; যেসব ব্যাপারে আবু বকর নম্রতা দেখাতেন, সেখানে উমর কঠোরতা প্রদর্শন করতেন যেন সিদ্ধান্তে ভারসাম্য বজায় থাকে। যখন উমর নিজে খলীফা হবেন, তখন আর এই অবস্থা থাকবে না। অজ্ঞতার যুগে বনু জাযিমার লোকেরা আব্দুর রহমান (রা.)’র পিতাকে ও হযরত খালিদ বিন ওয়ালীদের চাচাকে হত্যা করেছিল। মক্কা বিজয়ের পর মহানবী (সা.) বিভিন্ন স্থানে যখন তাঁর প্রতিনিধিদল প্রেরণ করেন, তখন হযরত খালিদকে বনু জাযিমার প্রতি প্রেরণ করেন। ভুলবশতঃ খালিদ সেখানে এক ব্যক্তিকে হত্যা করে ফেলেন, আর এজন্য মহানবী (সা.) খুবই অসন্তুষ্ট হন। ঘটনাচক্রে এই বিষয় নিয়ে হযরত আব্দুর রহমান ও হযরত খালিদ (রা.)’র মধ্যে বাদানুবাদ হয়ে যায়। মহানবী (সা.) যখন তা জানতে পারেন তখন বলেন, ‘আমার সাহাবীদের কিছু বলবে না। সেই সত্ত্বার শপথ যার হাতে আমার প্রাণ, তোমাদের মধ্যে কেউ যদি ওহুদ পাহাড়ের সমান স্বর্ণও ব্যয় করে, তবুও তাদের সামান্যমত ব্যয়ের সমানও হতে পারবে না!’ প্রথমদিকের সাহাবীদের মহান আত্মত্যাগের কারণে এত উচ্চ ছিল তাদের মর্যাদা! মহানবী (সা.) হযরত আব্দুর রহমান বিন অওফ (রা.) সম্পর্কে বলেন, ‘সে মুসলমানদের নেতাদেরও নেতা’; আর এ-ও বলেন, ‘আব্দুর রহমান আকাশেও আমীন (বিশ্বস্ত) এবং পৃথিবীতেও আমীন।’ মহানবী (সা.), তাঁর পরিবারবর্গ ও সাহাবীদের প্রতি হযরত আব্দুর রহমান (রা.)’র ভালোবাসা এত গভীর ছিল যে, স্বাচ্ছন্দ্যের যুগে বেশ কয়েকবার এমনও হয়েছে- তার সামনে সুস্বাদু খাবার-দাবার রাখা হলে তিনি তাঁদের কষ্টেভরা জীবনের কথা স্মরণ করে কাঁদতে কাঁদতে আহার ছেড়ে উঠে গিয়েছেন। আশারায়ে মুবাশশারার একজন হয়েও তার খোদাভীতির অবস্থা এমন ছিল যে, একদিন তিনি উম্মুল মুমিনীন হযরত উম্মে সালমার কাছে গিয়ে বলেন, ‘মা! আমার ভয় হয়- সম্পদের প্রাচুর্যের কারণে আমি আবার ধ্বংস না হয়ে যাই।’ উম্মে সালমা তাকে বলেন, ‘বাবা! আল্লাহ্র পথে ব্যয় করতে থাক, ধ্বংস হওয়ার প্রশ্নই আসে না।’
হযরত উমর (রা.) তার পরে খলীফা নির্বাচনের জন্য যে ছয়জনের কমিটি গঠন করে গিয়েছিলেন, তাদের একজন ছিলেন হযরত আব্দুর রহমান (রা.); হযরত উমর (রা.) এ-ও বলেছিলেন, যদি দু’জনের পক্ষে ভোট সমান সমান হয় তবে আব্দুর রহমান (রা.) যাকে ভোট দিবেন- তিনি-ই খলীফা হবেন। হযরত উমর (রা.)’র ওপর যেদিন নামাযের মধ্যে আক্রমণ হয়, তখন তিনি হযরত আব্দুর রহমান (রা.)-কেই টেনে নিয়ে ইমামের স্থানে দাঁড় করিয়ে দেন; আব্দুর রহমান (রা.) সংক্ষেপে নামায শেষ করেন। হযরত উমর (রা.) নির্দেশে আনসারদের একটি দল হযরত আবু তালহা বা হযরত মিকদাদ (রা.)’র নেতৃত্বে খিলাফত নির্বাচন কমিটির প্রহরায় থাকেন। অনেক আলোচনার পর খিলাফত নির্বাচন কমিটির সদস্যরা সবাই হযরত আব্দুর রহমান (রা.)’র ওপর এই দায়িত্ব অর্পণ করেন এবং তিনি মদীনার সকল মানুষের বাড়ি বাড়ি যান এবং তাদের সবার পরামর্শ ও মতামত নিয়ে হযরত উসমান (রা.)-কে খলীফা নির্বাচিত করেন এবং সর্বপ্রথম তার হাতে বয়আত করেন। হুযূর (আই.) বলেন, এ বিষয়ে একটি সুদীর্ঘ বর্ণনা রয়েছে, যা হযরত উমর বা হযরত উসমান (রা.)’র স্মৃতিচারণের সময়ও উল্লেখ করা যেতে পারে। আর হযরত আব্দুর রহমান বিন অওফের জীবন-চরিতের আরও কিছু ঘটনা রয়েছে, তা পরের খুতবায় বর্ণনা করা হবে, ইনশাআল্লাহ্।