সারমর্ম
এই জুমু’আর খুতবার সারাংশটিতে কোনো প্রকার ত্রুটি-বিচ্যুতি থাকলে তার দায়ভার আহ্মদীয়া বাংলা টীম গ্রহণ করছে।
নিখিলবিশ্ব আহমদীয়া মুসলিম জামাতের বর্তমান ইমাম ও আমীরুল মু’মিনীন হযরত মির্যা মসরূর আহমদ খলীফাতুল মসীহ্ আল খামেস (আই.) গত ৯ই জুন, ২০২৩ইং ইসলামাবাদের মসজিদে মুবারকে “মহানবী (সা.) এর জীবনী: বদর যুদ্ধের পূর্ববর্তী বিভিন্ন সামরিক অভিযান” বিষয়ক জুমুআর খুতবা প্রদান করেন। প্রদত্ত জুমুআর খুতবায় মুসলমানদের মদীনায় হিজরতের পর সংঘটিত বিভিন্ন অভিযান এবং বদরের যুদ্ধের উদ্দেশ্যে মক্কার কাফিরদের প্রস্তুতি সম্পর্কে আলোকপাত করেন।
তাশাহ্হুদ, তা’আউয ও সূরা ফাতিহা পাঠের পর হুযূর (আই.) বলেন, গত সপ্তাহে মদীনায় হিজরতের পর মুসলমানদের অবস্থা, বদরের যুদ্ধের কারণসমূহ এবং মক্কার কাফিরদের বিভিন্ন ষড়যন্ত্রকে প্রতিহত করার লক্ষ্যে মহানবী (সা.)-এর বিবিধ পদক্ষেপ বর্ণিত হয়েছে। আজ বদরের যুদ্ধের পূর্বে সংঘটিত বিভিন্ন সারিয়্যা ও গযওয়া এবং কাফিরদের বদরের যুদ্ধের প্রস্তুতি সম্পর্কে আলোচনা করব ইনশাআল্লাহ্।
মহানবী (সা.) ১ম হিজরীর রমযান মাসে হযরত হামযা বিন আব্দুল মুত্তালিবকে দলনেতা নিযুক্ত করে মুহাজিরদের ত্রিশজন আরোহীর একটি দল প্রেরণ করেছিলেন যাকে সারিয়্যা সাইফুল বাহারও বলা হয়ে থাকে। এর পতাকার রং ছিল সাদা এবং আবু মারসাদ (রা.) এটি বহন করেছিলেন। পথিমধ্যে আবু জাহলের নেতৃত্বে সিরিয়াগামী কুরাইশ দলের সাথে মুসলমান দলের মুখোমুখি সাক্ষাৎ হয়ে যায়। উভয়ের মাঝে লড়াই বেঁধে যাবার উপক্রম হলে বনু সুলাইম গোত্রের একজন সন্মানিত নেতার মধ্যস্থতায় এ যুদ্ধ স্থগিত হয় এবং উভয় দল স্ব স্ব স্থানে ফেরত চলে যায়।
এরপর ১ম হিজরীর শওয়াল মাসে মহানবী (সা.) হযরত উবায়দাহ্ বিন হারেস (রা.)’র নেতৃত্বে ৬০জন মুহাজিরের একটি দলকে সানীয়াতুল মার্রা অভিমুখে প্রেরণ করেন, যেটি সারিয়্যা উবায়দাহ্ বিন হারেস নামেও সুপরিচিত। কুরাইশ নেতা আবু সুফিয়ান এবং তার দুইশ’ আরোহীর সাথে মুসলমানদের সাক্ষাৎ হয়। উভয়পক্ষ পাল্টাপাল্টি তীর নিক্ষেপ করে, কিন্তু এ লড়াই দীর্ঘস্থায়ী হয় নি। ইসলামের ইতিহাসে এদিনই সর্বপ্রথম মুসলমানরা কাফিরদের উদ্দেশ্যে তীর নিক্ষেপ করে আর তীর নিক্ষেপের এই অনন্য সম্মান লাভ করেন হযরত সা’দ বিন আবী ওয়াক্কাস (রা.)।
এরপর সারিয়্যা হযরত সা’দ বিন আবী ওয়াক্কাস এর ঘটনা। কুরাইশের একটি বাণিজ্যিক কাফেলাকে প্রতিহত করতে মহানবী (সা.) হযরত সা’দ বিন আবী ওয়াক্কাস (রা.)’র নেতৃত্বে ২০জন সদস্যের একটি দল প্রেরণ করেন এবং নির্দেশ দেন তারা যেন খারার নামক উপত্যকা অতিক্রম না করেন। যখন তারা সে স্থানে পৌছায় তখন বুঝতে পারে, শত্রুরা ইতঃমধ্যে সেখান থেকে চলে গেছে। এরপর তারাও মদীনায় ফিরে আসেন।
অতঃপর গযওয়ায়ে ওয়াদ্দান বা আবওয়া’র যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল ২য় হিজরীতে সফর মাসে। মহানবী (সা.) ৬০-৭০ জন মুহাজিরে সাথে স্বয়ং এ দলের সাথে যোগদান করেন আর এটিই কোনো অভিযানে স্বশরীরে তাঁর সর্বপ্রথম অংশগ্রহণ ছিল। তাঁর ইচ্ছা ছিল কুরাইশের বাণিজ্যিক কাফেলাকে প্রতিহত করা, কিন্তু তিনি (সা.) সেখানে পৌঁছার পূর্বেই তারা সেখান থেকে চলে গিয়েছিল, তাই তিনি (সা.) বনু যামরার সাথে সন্ধিচুক্তি করে মদীনায় ফিরে আসেন।
২য় হিজরীর রবিউল আউয়াল মাসে গযওয়ায়ে বুওয়াত- এ মহানবী (সা.) কুরাইশের বাণিজ্যিক কাফেলাকে প্রতিহত করতে দু’জন সাহাবীকে নিয়ে মদীনা থেকে যাত্রা করেন। কাফিরদের এ দলে ১০০জন কুরাইশ এবং ২৫০০উট ছিল। বুওয়াত পৌছার পর মহানবী (সা.) কাউকে না পেয়ে মদীনায় ফিরে আসেন। এ অভিযানে হযরত সা’দ বিন আবী ওয়াক্কাস (রা.) সাদা পতাকা বহন করেছিলেন।
এরপর গযওয়ায়ে উশায়রাহ্ বা উশায়রাহ্র যুদ্ধের ঘটনার বিবরণ হলো। মহানবী (সা.) জানতে পারেন, কুরাইশের একটি বাণিজ্যিক কাফেলা মক্কা থেকে যাত্রা করেছে আর মক্কাবাসীরা তাদের সমস্ত পুঁজি এই ব্যবসায় বিনিয়োগ করেছে। এর পেছনে তাদের উদ্দেশ্য ছিল, এবারের ব্যবসায় অর্জিত লভ্যাংশের ষোলোআনা মুসলমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে ব্যবহার করা হবে। এ সংবাদ পেয়ে মহানবী (সা.) ১৫০ থেকে ২০০ জনের একটি দল নিয়ে ২য় হিজরীর জমাদিউল উলা বা জমাদিউস্ সানিতে সে দিকে যাত্রা করেন। উশায়রাহ্ পৌঁছে তিনি (সা.) জানতে পারেন, কয়েকদিন পূর্বেই সেই কাফেলা সেখান থেকে চলে গেছে। তিনি (সা.) কয়েকদিন সেখানে অবস্থান করেন এবং বনু মুদলেজ ও বনু যামরার সাথে সন্ধিচুক্তি করে মদীনায় ফিরে আসেন। কুরাইশের এ দলটি যখন সিরিয়া থেকে প্রত্যাবর্তন করছিল তখন মহানবী (সা.) পুনরায় তাদের পিছু ধাওয়া করেন এবং এ দলটির কারণেই পরবর্তীতে বদরের যুদ্ধ সংঘটিত হয়।
গযওয়ায়ে বদরুল্ উলা সম্পর্কে হুযূর (আই.) বলেন, উশায়রাহ্ থেকে ফেরার দশ দিন পার হওয়ার পূর্বেই কুরয বিন জাবের মদীনার চারণভূমিতে আক্রমণ করে এবং উট চুরি করে পালিয়ে যায়। মদীনায় হযরত যায়েদ বিন হারেসা (রা.)-কে স্থলাভিষক্ত নিযুক্ত করে মহানবী (সা.) তার পশ্চাদ্ধাবনে বের হন, কিন্তু সাফওয়ান নামক স্থানে পৌছে জানতে পারেন যে, সে সেখান থেকে পালিয়ে গেছে। তাই তিনি মদীনায় ফেরত চলে আসেন। কুরয বিন জাবের এর আক্রমণ কোনো সাধারণ আক্রমণ ছিল না, বরং সে কুরাইশের পক্ষ থেকে বিশেষ উদ্দেশ্যে অর্থাৎ মহানবী (সা.)-এর ওপর আক্রমণের জন্য এসেছিল। কিন্তু মুসলমানদেরকে চৌকস বা সতর্ক দেখতে পেয়ে সে কেবলমাত্র উট চুরি করেই পালিয়ে যায়।
এরপর সারিয়্যা আব্দুল্লাহ্ জাহ্শ সম্পর্কে লিপিবদ্ধ আছে, ৩য় হিজরীর রজব মাসে মহানবী (সা.) আব্দুল্লাহ্ বিন জাহ্শ (রা.)’র নেতৃত্বে ৮জন মুহাজিরের একটি দল প্রেরণ করেন। মহানবী (সা.)-এর নির্দেশ ছিল তারা যেন সেখানে গিয়ে কুরাইশের গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করেন এবং মহানবী (সা.)-কে অবহিত করেন। কিন্তু তারা নাখলায় গিয়ে পরিস্থিতির শিকার হয়ে বাণিজ্যিক কাফেলার ওপর আক্রমণ করে বসে এবং তাদের নেতা আমর বিন হাযারামীকে হত্যা করে আর দু’জনকে বন্দী করে মহানবী (সা.)-এর সমীপে নিয়ে আসে। সেই দিনটি নিষিদ্ধ মাস অর্থাৎ রজব মাসের শেষ দিন ছিল। তাই তিনি (সা.) হাযরামীকে হত্যার জন্য তাদেরকে ভর্ৎসনা করেন এবং বলেন, “আমি তোমাদেরকে এই নিষিদ্ধ মাসে যুদ্ধ করতে বলি নি”। এরপর তাদের নিয়ে আসা কোনো সম্পদ গ্রহণেও তিনি অস্বীকৃতি জানান। যাহোক, পবিত্র কুরআনে নিষিদ্ধ মাসের কার্যক্রম সম্পর্কে সূরা আল্ বাকারার ২১৮ নাম্বার আয়াত يَسْأَلُونَكَ عَنِ الشَّهْرِ الْحَرَامِ قِتَالٍ فِيهِ قُلْ قِتَالٌ فِيهِ كَبِيرٌ وَصَدٌّ عَنْ سَبِيلِ اللَّهِ وَكُفْرٌ بِهِ وَالْمَسْجِدِ الْحَرَامِ وَإِخْرَاجُ أَهْلِهِ مِنْهُ أَكْبَرُ عِنْدَ اللَّهِ وَالْفِتْنَةُ أَكْبَرُ مِنَ الْقَتْلِ وَلَا يَزَالُونَ يُقَاتِلُونَكُمْ حَتَّى يَرُدُّوكُمْ عَنْ دِينِكُمْ إِنِ اسْتَطَاعُوا অবতীর্ণ হলে মুসলমানরা স্বস্তি পায় এবং কাফিরারও নিশ্চুপ হয়ে যায়। এরপর মহানবী (সা.) মৃত ব্যক্তির ফিদিয়া প্রদান করেন এবং মুক্তিপন নিয়ে দু’জন বন্দীকেও মুক্ত করে দেন।
বদরের যুদ্ধের পটভূমি সম্পর্কে হুযূর (আই.) বলেন, বদরের যুদ্ধকে ইয়াউমুল ফুরকানও বলা হয় যার অর্থ হলো, সত্য-মিথ্যার পার্থক্য নির্ণয়কারী দিন; যেদিন শক্তিশালী বিরোধীরা ধ্বংস হয়েছিল এবং মুসলমানরা জয়ী হয়েছিল। এর আরো অনেকগুলো নাম রয়েছে যেমন, বদরুস্ সানীয়্যা, বদরুল্ কুবরা, বদরুল্ উযমা এবং বদরুল্ কিতাল। মহানবী (সা.) যখন জানতে পারেন, কুরাইশের নেতা আবু সুফিয়ানের একটি বাণিজ্যিক কাফেলা ব্যবসা করে ফেরত আসছে যাদের মাঝে ত্রিশ, চল্লিশ বা সত্তর জন সদস্য এবং এক হাজার উট বোঝাই কুরাইশের বিশাল সম্পদ রয়েছে, তাদের প্রতিহত করতে ২য় হিজরীর জমাদিউল উলা বা জমাদিউল আখের মাসে মদীনা থেকেইতনি যাত্রা করেন। কতিপয় স্বল্পজ্ঞানী লোক আপত্তি করে থাকে যে, মহানবী (সা.) তাদের সম্পদ লুট করার উদ্দেশ্যে বের হয়েছিলেন। কিন্তু এর কারণ বর্ণনা করে হযরত মির্যা বশীর আহমদ সাহেব এম. এ (রা.) বলেন, এ কাফেলাকে প্রতিহত করার জন্য বের হওয়া মোটেও আপত্তিকর হতে পারে না, কেননা এটি অস্বাভাবিক কাফেলা ছিল এবং এটি প্রমাণিত ছিল যে, তারা তাদের ব্যবসার পুরো লভ্যাংশ মুসলমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের পেছনে ব্যবহার করার সংকল্প করেছিল। ইতিহাস থেকে জানা যায়, পরবর্তীতে উহুদের যুদ্ধে এ লভ্যাংশ ব্যবহারও করা হয়েছে। মোটকথা, তাদের প্রতিহত করা যুদ্ধের গুরত্বপূর্ণ কৌশল ছিল। আবু সুফিয়ান মুসলমানদের অগ্রসর হওয়ার খবর পেয়ে ভীতত্রস্ত হয় এবং নিজের দূতকে মক্কায় গিয়ে খবর দিতে বলে এবং স্বীয় দলবল নিয়ে বদরের প্রান্তর ছেড়ে দ্রুতবেগে অন্যদিকে সরে যায়।
এদিকে মক্কায় মহানবী (সা.)-এর ফুপু আতেকা বিন আব্দুল মুত্তালিব একটি স্বপ্ন দেখেছিলেন যা সত্য প্রমাণিত হয়েছিল। হুযূর (আই.) এটি বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন, আবু সুফিয়ানের দূত মক্কায় পৌছার তিন রাত পূর্বে তিনি স্বপ্নে দেখেন, এক ব্যক্তি উটে আরোহণ করে প্রথমে আবতাহ্র প্রান্তরে, এরপর কাবাগৃহের ছাদে, এরপর আবু কুবায়েস পাহাড়ের চূড়ায় উঠে উচ্চস্বরে এ ঘোষণা দেয় যে, তিন দিনের মধ্যে যেন লোকেরা যুদ্ধক্ষেত্রে পৌছে যায়। তিনি এ স্বপ্নটি তার ভাই আব্বাসকে বলেন যা পর্যায়ক্রমে আবু জাহ্লের কানে পৌঁছে যায়। আবু জাহ্ল বলে, আমরা তিন দিন অপেক্ষা করি। যদি এমনটি হয় তাহলে ঠিক আছে, নতুবা আমরা কাবার দেয়ালে টাঙ্গিয়ে দিব যে, তুমি আরবের মাঝে সবচেয়ে বড় মিথ্যাবাদী। ইতঃমধ্যে সেই দূত মক্কায় পৌঁছে বিস্তারিত অবগত করে। কুরাইশরা এমনিতেই যুদ্ধের অজুহাত খুঁজছিল। এ ঘোষণা শুনে তারা পূর্ণ প্রস্তুতি নিতে থাকে। কুরাইশের পাঁচ নেতা তীর নিক্ষেপের মাধ্যমে লটারী করে নেতিবাচক ইঙ্গিত পায়, কিন্তু তবুও আবু জাহ্লের একগুঁয়েমির কারণে তারা যুদ্ধে যেতে সম্মত হয়ে যায়। হুযূর (আই.) বলেন, এর বিস্তারিত বিবরণ আগামীতে বর্ণনা করা হবে, ইনশাআল্লাহ্।