সারমর্ম
এই জুমু’আর খুতবার সারাংশটিতে কোনো প্রকার ত্রুটি-বিচ্যুতি থাকলে তার দায়ভার আহ্মদীয়া বাংলা টীম গ্রহণ করছে।
নিখিল বিশ্ব আহমদীয়া মুসলিম জামাতের বর্তমান ইমাম হযরত মির্যা মসরূর আহমদ খলীফাতুল মসীহ্ আল্ খামেস (আই.) গত ২০শে জানুয়ারী, ২০১৭ইং রোজ শুক্রবার লন্ডনের বাইতুল ফুতুহ্ মসজিদে “নামাযের গুরুত্ব ও আবশ্যকতা”- সম্পর্কে জুমুআর খুতবা প্রদান করেন।
তাশাহুদ, তাঊয, তাসমিয়া এবং সূরা ফাতিহা পাঠের পর হুযূর আনোয়ার (আই.) বলেন,
নামায যে মুসলমানদের জন্য একটি ফরয বা আবশ্যক ইবাদত তা সকলেই জানে। পবিত্র কুরআনে বহুবার বিভিন্ন আঙ্গিকে ও প্রেক্ষাপটে নামাযের গুরুত্ব ও আবশ্যকতা বর্ণিত হয়েছে। মহানবী (সা.)-এর বিভিন্ন হাদীস থেকেও নামাযের আবশ্যকতা ও গুরুত্ব উপলদ্ধি করা যায়। হুযুর (আই.) বিভিন্ন হাদীসের উল্লেখ করে বলেন, যেগুলো থেকে সাব্যস্ত হয় যে নামায যাবতীয় ইবাদতের সার; নামায পরিত্যাগ মানুষকে কুফর ও শিরকের নিকটবর্তী করে এবং কেয়ামতের দিন সর্বপ্রথম নামাযের হিসাব নেয়া হবে ইত্যাদি। মহানবী (সা.) সন্তানদের নামাযের ব্যাপারে পিতা-মাতাদের নির্দেশ দিয়েছেন, দশ বছর পর্যন্ত তাকিদ করা সত্ত্বেও যদি সন্তান নামায না পড়ে তবে তার প্রতি কঠোরতা করতে হবে। হুযুর (আই.) বলেন, যদি বাবা-মা নিজে নামায না পড়েন আর কেবল সন্তানকে নির্দেশ দিতে থাকেন, তবে সন্তানের উপর এর কোন প্রভাবই পড়বে না। বরং তারা যখন দেখবে যে জামাতী বিভিন্ন অনুষ্ঠানে নামাযের ব্যাপারে বলা হলেও তার বাবা-মা একে গুরুত্ব দেয় না, তখন তারা শুধু নামাযই নয়, বরং অন্যান্য ইসলামী আদেশ-নিষেধের গুরুত্বের ব্যাপারেও সন্দিহান হয়ে পড়বে। ফলে এমন পিতা-মাতা রসূলুল্লাহ (সা.)-এর নির্দেশই কেবল অমান্য করছে না, বরং নিজেদের সন্তানদেরকেও ক্ষতিগ্রস্তদের দলভুক্ত করছে। পিতা-মাতারা সন্তানের পার্থিব বিভিন্ন বিষয়ে উন্নতির ব্যাপারে উদ্বিগ্ন থাকে, অথচ প্রকৃত উদ্বেগ যে বিষয়ে থাকা উচিত- তার প্রতি বিন্দুমাত্র ভ্রুক্ষেপ করে না।
হুযুর (আই.) মহানবী (সা.)-এর হাদীসের বরাতে নামায কিভাবে পাপ থেকে দূরে রাখে তার উল্লেখ করেন। দৈনিক পাঁচ বেলার নামায পাঁচবার নদীতে গোসল করার মত করে পাপ ধুয়ে দেয়। মহানবী (সা.) তিনটি বিষয়ের উল্লেখ করেন যার মাধ্যমে পাপ মুছে যায়; এর প্রথমটি হল কষ্ট ও অনীহা সত্ত্বেও ভালভাবে ওযু করা, দূর থেকে হেঁটে মসজিদে বাজামাত নামাযের জন্য আসা ও এক নামাযের পর আরেক নামাযের জন্য অপেক্ষা করা। রসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, একাজটি এক ধরনের রিবাত বা সীমান্তে পাহারা বসানো। যেভাবে শত্রুর আক্রমণ থেকে দেশকে রক্ষার জন্য সীমান্তে প্রহরা বসানো হয়, তেমনি একজন মুমিনের জন্য সবচেয়ে বড় শত্রু শয়তানের আক্রমণ থেকে বাঁচার জন্য প্রহরা হল বাজামাত নামায। আর একাকী নামায পড়ার চেয়ে বাজামাত নামায পড়ায় সাতাশগুণ অধিক পুণ্য লাভ হয়। মসীহ মাওউদ (আ.) এটিকে ব্যাখ্যা করে বুঝিয়েছেন যে, এর কারণ হল বাজামাত নামাযের মাধ্যমে ঐক্য সৃষ্টি হয়; পরস্পর গা ঘেঁষে একই কাতারে যখন দাঁড়ানো হয় তখন এর ফলে একদিকে ঐক্যবোধ সৃষ্টি হয়, অহংকার ও স্বার্থপরতা দূর হয় এবং আধ্যাত্মিকভাবে সবল ব্যক্তির প্রভাব দুর্বলদের উপর পড়ে। হুযুর (আই.) বলেন, আল্লাহ তা’আলার কৃপায় আমরা ইমাম মাহদী (আ.)-কে মান্য করে তাঁর কাছ থেকে বাজামাত নামাযের সঠিক জ্ঞান ও ব্যুৎপত্তি লাভ করতে পেরেছি। আমরা যদি তাঁকে মানার দাবী করা সত্ত্বেও মৌলিক ইসলামী শিক্ষা পালনে বা এক্ষেত্রে ন্যূনতম মান অর্জনের ক্ষেত্রে উদাসীন হই, তবে তাঁকে মানার আমাদের দাবী কিভাবে সঠিক হতে পারে? হুযুর (আই.) আরও বলেন, পবিত্র কুরআন ও রসূলুল্লাহ (সা.)-এর হাদীস থেকে সাবালক ও বুদ্ধিমান মুসলমান পুরুষের জন্য বাজামাত নামায আবশ্যক হওয়া সত্ত্বেও এক্ষেত্রে দুর্বলতা দেখা যায়। যদিও একজন সত্যিকার মুমিনের নিজেরই এ ব্যাপারে সচেতন হওয়া উচিত, কিন্তু জামাতের যে ব্যবস্থাপনা রয়েছে তারও সর্বদা এদিকে সবার মনোযোগ আকর্ষণ করতে থাকা উচিত। প্রায়শঃ খুতবায় এদিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়, কিন্তু এ ধ্বনির ক্রমাগত প্রতিধ্বনি সৃষ্টি করার দায়িত্ব মুরব্বীদের ও জামাতের ব্যবস্থাপনার। হুযুর (আই.) বলেন, প্রকৃতপক্ষে আমাদের আহমদী হবার দায়িত্ব তখন পূর্ণ হবে, যখন আমরা নামাযে আধ্যাত্মিকতার স্বাদ লাভ করতে পারব।
নামাযে আধ্যাত্মিকতার স্বাদ কিভাবে লাভ করা যায়, সে সম্পর্কে হুযুর (আই.) হযরত মসীহ মাওউদ (আ.)-এর বরাতে উল্লেখ করেন যে, একজন মদ্যপায়ী যতক্ষণ পর্যন্ত তার নেশা না ধরে ততক্ষণ পান করে যেতে থাকে; তেমনিভাবে আধ্যাত্মিকতা বৃদ্ধির উপায় হল নিয়মিতভাবে নামায পড়ে যাওয়া এবং কখনো নামায বাদ না দেয়া, যে পর্যন্ত না সে নামাযের স্বাদ লাভ করে। আল্লাহ তা’আলা বলেন, নামায মানুষকে অশ্লীলতা ও মন্দকর্ম থেকে বিরত রাখে। কিন্তু অনেকে নামায পড়া সত্ত্বেও মন্দকর্ম থেকে বিরত হয় না। হযরত মসীহ মাওউদ (আ.) বলেন, এমন মানুষরা আসলে হৃদয়ের গভীর থেকে ও প্রকৃত নিষ্ঠার সাথে নামায পড়ে না, বরং প্রথাগতভাবে নামায পড়ে। তাই আমাদের এ দৃষ্টিকোণ থেকেও আত্মবিশ্লেষণ করতে হবে।
হুযুর (আই.) বলেন, মানুষ যখন বিপদে পড়ে তখন নামায ও দোয়ায় স্থায়ীভাবে মনোযোগ থাকে, কিন্তু যখন বিপদ দূর হয়ে যায় তখন অনেকেই নামাযে বিনয়াবনত দোয়া ও মনোযোগের ব্যাপারে উদাসীন হয়ে যায়। কিন্তু মসীহ মাওউদ (আ.) অবস্থা যেমনই হোক না কেন, সর্বাবস্থায় আমাদেরকে নামাযের সেই স্বাদ ও আনন্দ লাভের জন্য চেষ্টা করে যেতে হবে যা নেশার মত অবস্থা সৃষ্টি করে। আর সমাজের সার্বিক অবস্থাও একজন মুমিনের হৃদয়ে বেদনা সৃষ্টি করা উচিত। হুযুর (আই.) পাকিস্তানের উল্লেখ করে বলেন, সেখানে এখন এমনই অবস্থা বিরাজ করছে যে সর্বত্র আহমদীয়তের বিরোধিতা চরম রূপ পরিগ্রহ করেছে। কিন্তু এর ফলে যে ব্যাকুলচিত্ততার সাথে প্রত্যেকের বাজামাত নামাযে অংশ নেয়ার কথা, সেরকমটি তো দেখা যাচ্ছে না। কেবলমাত্র রিপোর্টের সংখ্যার ঘর পূরণ করে কী লাভ হবে যদি আমাদের নামাযে আধ্যাত্মিকতার স্বাদ সৃষ্টি না হয় আর বাজামাত নামাযীর সংখ্যা বৃদ্ধি না পায়? আমরা যদি কেবলমাত্র মুখে মসীহ মাওউদ (আ.)-কে মান্য করার দাবী করি, আর কার্যত নিজেদের অবস্থা পরিবর্তন না করি এবং আশা করতে থাকি যে এতেই আমরা বিজয় ও সাফল্য লাভ করব, তবে তো (নাউযুবিল্লাহ) আমরা যেন স্বয়ং খোদা তা’আলার পরীক্ষা নিচ্ছি যে এসব সত্ত্বেও তিনি আমাদেরকে বিজয়মন্ডিত করবেন। হুযুর (আই.) যদিও পাকিস্তানের কথা উল্লেখ করেছেন, কিন্তু তিনি বলেছেন যে নামাযের এই অবস্থা সারা বিশ্বেই রয়েছে।
হুযুর (আই.) বলেন, অনেক সময় দেখা যায় কেউ কেউ দুই-তিন বেলা বাজামাত নামায পড়েন, কিন্তু দুই-এক বেলা নামায ছেড়েও দেন। এর কারণ হল জামাতের ব্যবস্থাপনা তাদেরকে স্মরণ করায় না, অথচ এটি ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব। হুযুর (আই.) ব্যবস্থাপনাকে এ ব্যাপারে জোরালো নির্দেশ দেন। হুযুর (আই.) আরও বলেন, যদি আমরা নামাযের মত মৌলিক নির্দেশের উপর সম্পূর্ণরূপে আমল না করি, তবে অ-আহমদীদের মত এরূপ দুই-তিন বেলার নামাযের কোন মূল্যই নেই। মসীহ মাওউদ (আ.) যেমনটি বলেছেন, প্রথমে নিয়মিত নামাযের অভ্যাস গড়তে হবে; যখন বিনয় ও নিষ্ঠার সাথে নামায পড়তে থাকবে তখন একসময় নামায উপভোগ্য হয়ে উঠবে।
খুতবার শেষে এসে হুযুর (আই.) দোয়া করেন যে আল্লাহ তা’আলা আমাদের নামাযের সুরক্ষা বিধানের তৌফিক দিন, অবিচলভাবে নামায পড়ার তৌফিক দিন, নিষ্ঠা ও আন্তরিকতার সাথে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য নামায পড়ার তৌফিক দিন, আমাদের নামাযে স্বাদ ও আনন্দ দান করুন, আমরা যেন কখনো নামাযে আলস্য না দেখাই এবং আমরা যেন একথার মর্ম অনুধাবন করতে পারি যে আজ বিশ্বের বিপদাপদ থেকে মুক্তির মাধ্যম হল আল্লাহ তা’আলার দাসত্বের দায়িত্ব পালন। আল্লাহুম্মা আমীন।