بِسۡمِ اللّٰہِ الرَّحۡمٰنِ الرَّحِیۡمِِ
২০ এপ্রিল, ২০১৮
তবলীগের গুরুত্ব, প্রয়োজনীয়তা এবং আহমদীদের দায়িত্ব
মসজিদে বাশারাত, পেড্রোয়াবাদ, স্পেন
  • সারমর্ম
    এই জুমু’আর খুতবার সারাংশটিতে কোনো প্রকার ত্রুটি-বিচ্যুতি থাকলে তার দায়ভার আহ্‌মদীয়া বাংলা টীম গ্রহণ করছে।

    আহমদীয়া মুসলিম জামা’তের বিশ্ব-প্রধান ও পঞ্চম খলীফাতুল মসীহ্‌ হযরত মির্যা মসরূর আহমদ (আই.) গত ২০শে এপ্রিল, ২০১৮ইং স্পেনের পেড্রোয়াবাদে অবস্থিত মসজিদে বাশারাত থেকে তবলীগের গুরুত্ব, প্রয়োজনীয়তা এবং আহমদীদের দায়িত্ব প্রসঙ্গে জুমুআর খুতবা প্রদান করেন।

    তাশাহহুদ, তাআ’ব্বুয ও সূরা ফাতিহা পাঠের পর সূরা হামীম আস্ সাজদার ৩৪ নাম্বার আয়াত পাঠ করে হুযূর খুতবা শুরু করেন যার বঙ্গানুবাদ হল: “আর কথা বলার ক্ষেত্রে তার চেয়ে উত্তম আর কে হতে পারে, যে আল্লাহ্‌র দিকে ডাকে, সৎকর্ম করে এবং বলে, ‘নিশ্চয় আমি পরিপূর্ণ আনুগত্যকারীদের অন্তর্ভুক্ত’?” হুযূর (আই.) বলেন, এই আয়াত সেসব বৈশিষ্ট্যের চিত্র অঙ্কন করেছে যা একজন মু’মিনের মাঝে বিদ্যমান থাকা উচিত। এখানে আল্লাহ্ তা’লা তিনটি বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করেছেন, যদি এগুলো কারো মাঝে থাকে তবে তার জীবনে বিপ্লব সাধিত হতে পারে; শুধু তার ব্যক্তিজীবনেই নয়, বরং সমাজেও সে বিপ্লব সাধন করতে পারে। এই তিনটি বিষয় হল, দাওয়াত ইলাল্লাহ্ বা আল্লাহ্‌র দিকে আহ্বান করা, আমলে সালেহ বা সৎকর্ম করা এবং ইতায়াত বা আনুগত্যের দৃষ্টান্ত প্রদর্শনের মাধ্যমে এই ঘোষণা দেয়া যে, আমি আল্লাহ্ ও তাঁর রসূলের প্রত্যেক নির্দেশ পালনকারী বা পালনের যথাসাধ্য চেষ্টা করি। এগুলো এমন বিষয়, যার মধ্যে প্রথমটি একজন মু’মিনকে ধর্মীয় শিক্ষা অর্জনকারী ও অন্যদের মাঝে সেই শিক্ষা প্রচারকারীতে পরিণত করে; যা তাকে একথা শেখায় যে, পৃথিবীবাসীকে শেখাও আল্লাহ্ তা’লার অধিকার কী আর তা তোমরা কীভাবে প্রদান করবে, তোমাদের নিজেদের পরষ্পরের প্রতি কী অধিকার আছে এবং তা কীভাবে প্রদান করা সম্ভব। অন্যদেরকে এসব শিক্ষা দেয়ার প্রতি তখনই মনোযোগ সৃষ্টি হতে পারে, যখন তাদের প্রতি হৃদয়ে একপ্রকার বেদনা থাকে, তাদেরকে শয়তানের কবল থেকে রক্ষার ব্যাপারে মনে একপ্রকার উদ্বেগ বা উৎকণ্ঠা থাকে।

    দ্বিতীয় বৈশিষ্ট্য হল সৎকর্ম সাধন, অর্থাৎ আল্লাহ্ ও তাঁর বান্দাদের প্রাপ্য অধিকার প্রদানের জন্য শুধুমাত্র নির্দেশই দেবে না, বরং স্বয়ং তা পালন করে অন্যদের জন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন কর। নতুবা তোমাদের ধর্মীয় জ্ঞানও অর্থহীন, আর তবলীগ করার মত পুণ্যকর্মও আল্লাহ্‌র আশিস ও উত্তম ফলাফল থেকে বঞ্চিত থাকবে।

    আর তৃতীয় বৈশিষ্ট্য হল, প্রকৃত মু’মিন এই ঘোষণা দেবে- ‘আমি পরিপূর্ণ আনুগত্যকারীদের অন্তর্ভুক্ত’; অর্থাৎ সে ঘোষণা দেয় যে, সে আল্লাহ্ ও রসূলের সকল নির্দেশের ওপর বিশ্বাস রাখে, আর শুধু বিশ্বাসই রাখে না বরং তা নিজ জীবনের অংশে পরিণত করে, সে ধর্মকে পার্থিবতার ওপর প্রাধান্য দেয় এবং দিতে থাকবে।

    হুযূর বলেন, আনুগত্যের মধ্যে খিলাফত ও জামাতের ব্যবস্থাপনাও অন্তর্ভুক্ত; কারো একথা বলা যে, ‘আমি অনেক তবলীগ করি, আমার অনেক জ্ঞান আছে, আমার কোন জামাত বা ব্যবস্থাপনাকে মানার দরকার নেই’- এগুলো ভ্রান্ত রীতি। কারণ আল্লাহ্ তা’লা যেহেতু এ যুগে একটি জামাত প্রতিষ্ঠা করেছেন, তাই তার সাথে সম্পৃক্ত হওয়া আবশ্যক। ‘নিশ্চয়ই আমি পরিপূর্ণ আনুগত্যকারীদের অন্তর্ভুক্ত’ এই ঘোষণার মাঝে এ বিষয়টি প্রচ্ছন্ন রয়েছে। সত্যিকার অর্থে, পুণ্যকর্ম ও তাকওয়ার উচ্চমান অর্জনের জন্য এরূপ পরিপূর্ণ আনুগত্য একান্ত আবশ্যক। কখনও কখনও দেখা যায়, বাহ্যত পুণ্যবান বা ধর্মের সেবক কোন ব্যক্তির শেষ পরিণাম শুভ হয় না; আল্লাহ্ বলছেন, কথা বলার ক্ষেত্রে সর্বোত্তম ব্যক্তি বা পুণ্যকর্মের উত্তম দৃষ্টান্ত স্থাপনকারী ব্যক্তিরও শুভ পরিণাম তখন হবে, যখন সে এই ঘোষণা দেবে যে, ‘আমি আনুগত্যকারী, আমি আল্লাহ্‌র প্রতিষ্ঠিত ব্যবস্থাপনার পরিপূর্ণ আনুগত্য করি’। আমাদের আহমদীদের জন্য আনুগত্যের এই মান তখন প্রতিষ্ঠিত হবে, বা আমাদের তবলীগ তখন ফলপ্রসূ হবে, বা আমাদের পুণ্যকর্ম তখন আমলে সালেহ বলে গণ্য হবে- যখন আমরা মসীহ্ মওউদ (আ.)-এর পর প্রতিষ্ঠিত খিলাফত ব্যবস্থাপনার পূর্ণ আনুগত্য করবো, আর খিলাফতের অধীনে যে ব্যবস্থাপনা রয়েছে সেটিরও যথাযথ আনুগত্য করবো।

    হুযূর (আই.) বলেন, আল্লাহ্ তা’লা যখন স্বীয় প্রতিশ্রুতি ও মহানবী (সা.)-এর ভবিষ্যদ্বাণী অনুসারে মসীহ্ মওউদ (আ.)-কে পাঠিয়েছেন, তখন যে কাজ তাঁর দ্বারা সম্পাদিত হবার কথা তা অবশ্যই হবে, ইনশাআল্লাহ্। কিছু কাজ তাঁর জীবদ্দশায় পূর্ণ হয়েছে, আর কিছু তাঁর মৃত্যুর পর পূর্ণ হবার ছিল এবং তা-ই হয়েছে এবং হচ্ছে। আল্লাহ্ তা’লা যে উদ্দেশ্যে তাঁর নবীকে পাঠান তা অবশ্যই পূর্ণও করেন। আল্লাহ্ তা’লা কুরআনে এ সংক্রান্ত ঘোষণা দিয়ে রেখেছেন, “কাতাবাল্লাহু লাআগলিবান্না আনা ওয়া রুসুলী” অর্থাৎ ‘আল্লাহ্ এটি লিখে রেখেছেন, নিশ্চয়ই আমি ও আমার রসূলগণ বিজয়ী হব’; মসীহ্ মওউদ (আ.)-এর ওপরও কয়েকবার একথা ইলহাম করেছেন। এছাড়া আরও অনেক ইলহাম করেছেন যেগুলোতে তাঁর ওপর প্রদত্ত দায়িত্ব অর্থাৎ, ইসলাম প্রচারের পরিপূর্ণতা এবং এক্ষেত্রে তাঁকে সাফল্য লাভের সুসংবাদ প্রদান করেছেন। এর কিছুটা তার হাতে এবং বাকিটা তার পরে প্রতিষ্ঠিত খিলাফতের মাধ্যমে হওয়ার ছিল, আজ তা-ই হচ্ছে।

    হুযূর বলেন, আজ এমটিএ’র মাধ্যমে অহোরাত্র ইসলামের যে প্রচার কাজ চলছে, আমার খুতবা ইত্যাদি সরাসরি বিভিন্ন ভাষায় অনূদিতও হচ্ছে- এগুলো সবই আল্লাহ্‌র প্রতিশ্রুতির পূর্ণতা; নতুবা এই বিশাল কর্মকাণ্ড চালানোর মতো কোন সাধ্যই আমাদের ছিল না বা এখনও নেই। কেবলমাত্র আল্লাহ্ চাইছেন যে আমরা যেন তাঁর চালানো এই কর্মকাণ্ডে অংশীদার হই, তাই আমাদের এই সুযোগ দিচ্ছেন; আর সেজন্যই আমাদের আবশ্যক দায়িত্ব হল, আমরা যেন তবলীগের কাজে যথাসাধ্য অংশগ্রহণ করি। হুযূর স্পেনের জামাতের সাধারণ সদস্য, কর্মকর্তা, মুরব্বী, অংগসংগঠন মোটকথা সবাইকে সমন্বিত প্রোগ্রাম বানিয়ে বিশেষভাবে তবলীগ করার ব্যাপারে নির্দেশনা প্রদান করেন।

    হুযূর বলেন, আল্লাহ্ তা’লা আপনাদেরকে আর্থিক সাচ্ছন্দ্য দিয়েছেন এখন আপনাদের উচিত কমপক্ষে মাসে ২-৩দিন হলেও তবলীগের কাজে বের হওয়া। যদি বাজেটের সমস্যা থাকে তাহলে আপনারা কেন্দ্রেও লিখতে পারেন। প্রতিবছর যুক্তরাজ্য এবং জার্মানির জামেয়া থেকে পাশকরা নতুন মুরব্বীদের আমি এখানে পাঠিয়ে থাকি আর গত কয়েক বছরে তারা প্রায় ৩০লক্ষ লিফলেট এখানকার বিভিন্ন শহরে বিতরণ করেছে। ইউরোপের তুলনায় এখানকার মানুষ ধর্মের প্রতি বেশি আকর্ষণ রাখেন। তারা লিফলেট নেন এবং তা পড়েনও। তাই তাদের এই আগ্রহকে আমাদের কাজে লাগাতে হবে।

    তবলীগের গুরুত্ব সম্পর্কে হুযূর (আই.) হযরত মসীহ্ মওউদ (আ.) ও মহানবী (সা.)-এর বরাতে বেশ কিছু উদ্ধৃতি ও হাদীস উল্লেখ করেন। তবলীগ, ধর্মীয় জ্ঞান অর্জন এবং আহমদীদের দায়িত্ব ও কর্তব্য প্রসঙ্গে হুযূর গত খুতবার ন্যায় আজও কিশতিয়ে নূহ পুস্তকের আমাদের শিক্ষা অংশটি বারংবার পড়ার নির্দেশ দেন।

    একইভাবে হযরত মসীহ্ মওউদ (আ.)-এর উদ্ধৃতি মূলে পুণ্যকর্ম সাধনের বিষয়টি বিশদভাবে তুলে ধরেন। অনেকেই বাহ্যত পুণ্যকর্ম করে, কিন্তু এর উত্তম ফলাফল সৃষ্টি হতে দেখা যায় না; বস্তুত কেবল বাহ্যিকতার পূজা এবং লোক-দেখানো পুণ্যকর্ম বলেই এমন অবস্থা হয়। আল্লাহ্ প্রত্যেক কর্মের মূলে দৃষ্টিপাত করেন, তিনি দেখেন যে, কারও কর্মের মূলে ব্যক্তিস্বার্থ ও প্রবৃত্তির মিশেল আছে নাকি এতে প্রকৃতই আল্লাহ্‌র আনুগত্য ও নিষ্ঠা রয়েছে। তাই এদিকে আমাদের দৃষ্টি দিতে হবে।

    তিনি (আ.) একথাও বলেছেন যে, কর্মের প্রভাব তার বিশ্বাসের ওপরও পড়ে, অর্থাৎ পুণ্যকর্ম না করে অসৎকর্ম করলে তার ঈমানও বিনষ্ট হয়ে যায়। তিনি (আ.) বলেন, আমাদের জামাতের উচিত অনেক বেশি পুণ্যকর্ম করা; যদি আমার অনুসারীদের অবস্থাও অন্যদের মতই হয় তবে আর পার্থক্য কী থাকল, আর খোদা তা’লারই বা কী দরকার পড়েছে তাদেরকে কোন ছাড় বা নিরাপত্তা দেয়ার? অতএব কোন সৎকর্ম তখনই পুণ্যকর্ম বলে গণ্য হবে যখন তা পরিপূর্ণ আনুগত্য ও আল্লাহ্‌র সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে করা হবে, প্রবৃত্তির দেয়ালকে ভেঙে ফেলে তা করা হবে।

    হুযূর (আই.) বলেন, এটিও স্মরণ রাখবেন, ব্যবস্থাপনার বিরুদ্ধে অযথা অভিযোগ ব্যবস্থাপনা থেকে দূরে নিয়ে যায়, একইভাবে তা ধীরে ধীরে মানুষকে ধর্ম থেকে এবং খিলাফত থেকে দূরে নিয়ে যায়, আর পরিণতিতে আল্লাহ্ থেকেও দূরে ঠেলে দেয়।

    হযরত মসীহ্ মওউদ (আ.) বলেছেন, আমাদের বিজয়ের হাতিয়ার হল ইস্তেগফার, তওবা, ধর্মীয় জ্ঞান অর্জন, খোদা তা’লার মাহাত্ম্যকে দৃষ্টিপটে রাখা ও নিয়মিত পাঁচবেলার নামায পড়া। নামায দোয়া গৃহীত হবার চাবিকাঠি, তাই যখন নামায পড় তাতে দোয়া কর এবং অমনোযোগী হয়ো না; আর প্রত্যেক পাপ থেকে আত্মরক্ষা করো- তা আল্লাহ্‌র অধিকার প্রদানের বিষয়েই হোক বা বান্দার প্রাপ্য প্রদান সংক্রান্তই হোক।

    হুযূর (আই.) খুতবার শেষদিকে বলেন, আল্লাহ্ তা’লা আমাদেরকে হযরত মসীহ্ মওউদ (আ.)-এর বাণী প্রচারের ও বিজয় যাত্রার অংশ বানান; আমরা যেন তওবা-ইস্তেগফার ও দোয়ার মাধ্যমে তবলীগের দায়িত্ব পালনকারী হই, আল্লাহ্‌র ও বান্দার প্রাপ্য অধিকার প্রদানকারী হই, আমাদের প্রত্যেকটি কাজের উদ্দেশ্য যেন আল্লাহ্‌র সন্তুষ্টি হয়, আমরা যেন আল্লাহ্ তা’লার পরিপূর্ণ আনুগত্যকারীদের মাঝে অন্তর্ভুক্ত হই; যদি আমরা এ বিষয়গুলোর প্রতি মনোযোগ নিবদ্ধ রাখি তবে তাঁর প্রতিশ্রুতি মোতাবেক ইসলামের বিজয়ের দিনও দেখতে পাব, ইনশাআল্লাহ্- আল্লাহ্ তা’লা আমাদেরকে সেই তৌফিক দান করুন। (আমীন)

  • পুর্নাঙ্গ অনুবাদ
বিষয়ঃ
শেয়ার করুনঃ